সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ক্রুসেডের কারণ ও প্রেক্ষাপট | Causes and Background of the Crusades

 ক্রুসেডের কারণ ও প্রেক্ষাপট

১০৯৫ খিস্টাব্দে পোপ আরবান ফ্রান্সের ক্লেরমন্ত শহরে আহুত ধর্মসভায় মুসলমানদের হাত থেকে পবিত্র জেরুজালেম নগরী উদ্ধারের জন্য ধর্মযুদ্ধের প্রস্তাব রাখেন। এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর থেকে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সূচনা হয়, যা আগামী ২০০ বছর ধরে চলতে থাকে। এই যুদ্ধ ক্রুসেড নামে পরিচিত। পোপের অনুগামী ধর্মযোদ্ধারা বুকে ক্রুশ চিহ্ন নিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করত এবং যুদ্ধের পতাকাতেও এই চিহ্ন ব্যবহার করা হত। তাই এই ধর্মযুদ্ধকে ক্রুসেড বলা হয়।

ক্রুসেডের পটভূমি আলোচনা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ফিলিপ হিত্তি বলেছেন যে চার্চের ক্রুশ, সৈনিকদের তরবারি এবং বণিকদের অর্থভাণ্ডার মিলিত হয়ে ক্রুসেডের জন্ম দিয়েছিল। জেরুজালেম যীশুখ্রীষ্টের জন্মস্থান এবং একই সাথে মুহম্মদের মিরাজ গমনের স্থান। তাই জেরুজালেম উভয় ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হত। একই সাথে ইহুদীদের পয়গম্বর মোজেস এবং দাউদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান হওয়ায় ইহুদিদের কাছেও এটি পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হত। সপ্তম শতকে আরব মুসলিমরা জেরুজালেম অধিকার করে। কিন্তু প্রথমদিকে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের সাথে এই নিয়ে কোন সংঘাত হয়নি। কিন্তু একাদশ শতকে যখন সেলজুক তুর্কিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখন থেকে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের বাতাবরণ তৈরি হয়। সেলজুক তুর্কিরা তীর্থ যাত্রীদের উপর আকথ্য অত্যাচার করত এবং সেই অত্যাচারের কথা ইউরোপে প্রচলিত হলে সেখানে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তাছাড়া খলিফা আল হাকিম খ্রিস্টানদের পবিত্র সমাধি ও গির্জা ধ্বংস করে দিলে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লাগে এবং তারা এর প্রতিবিধানের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। 

একাদশ শতকে রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে পোপের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছিল। কিন্তু পোপ দ্বিতীয় আরবান সপ্তম গ্রোরির ন্যায় একছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। গ্রীক খ্রিস্টানদের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে পোপ বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল এক গণউত্তেজনা। খ্রিস্টানদের উত্তেজিত করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করতে পারলে পোপ আবার সমহিমায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে পারবেন এবং পবিত্র রোমান সম্রাট এর উপর প্রভাব পূন:প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।

ক্রুসেড এর পশ্চাতে যথেষ্ট অর্থনৈতিক কারণও ছিল। ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যপথ দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের অধীনে ছিল এর ফলে ইতালির বণিকদের বাণিজ্যিক স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছিল। এই বণিকরাই পোপকে ধর্মযুদ্ধের জন্য সমর্থন ও সহায়তা করেছিল। একই কারণে ইউরোপে বাণিজ্য সংকট দেখা দিয়েছিল, যা অর্থনীতির উপরে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। দশম শতকে ইউরোপে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বহু মানুষের জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্রের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার সামন্ততান্ত্রিক আইন এই সংখ্যাকে আরো ঘনীভূত করে। ফলে সমাজে লুঠতরাজের মত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় যা এক বিক্ষুদ্ধ জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এরাই দলে দলে ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করেছিল। 

অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের ফলে সমাজের প্রত্যেকটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কৃষক ও ভূমিদাস। ভূমিদাসরা দীর্ঘদিন ধরে সামন্ত প্রভুর অত্যাচার সহ্য করে আসছিল। তারা মনে করেছিল ধর্মযুদ্ধে অংশ নিলে তাদের এই অত্যাচার থেকে মুক্তি হবে। ভবঘুরে ও সমাজবিরোধীরা মনে করেছিল ধর্মযুদ্ধে তারা সম্পত্তি লাভ করবে, বসবাসের জন্য নতুন দেশ পাবে এবং যদি শহীদ হয়ে যায় তাহলে তাদের জন্য স্বর্গের দরজা খুলে যাবে। অন্যদিকে সামন্তপ্রভুরাও চাইছিল ক্রুসেডের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি করতে। তাদের অনুমান ছিল, যত যুদ্ধ হবে তত নতুন এলাকা দখল হবে। তার ফলে জমি বাড়বে, ভূমিদাসও বাড়বে।

রোমান ও গ্রীকরা গর্ববোধ করত এই ভেবে যে তারাই সভ্যতার ধারক ও বাহক। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাব ও দ্রুত প্রসারের ফলে গ্রিক ও রোমানদের সেই প্রভাব অনেকখানি নষ্ট হয় এবং তাদের অহংকার চূর্ণ হয়ে যায়। এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকায় ইসলামের অধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে রোমান ও গ্রীকরা ক্রমশ কোন ঠাসা হয়ে পড়ে। সুতরাং নিজেদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য শেষ চেষ্টায় হিসেবে ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। 

সুতরাং সমগ্র খৃস্টান জগত রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিকভাবে কোনঠাসা হয়েছিল। এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তারের জন্য তারা মরিয়া হয়ে পড়েছিল আর এখান থেকেই ক্রুশেডের উদ্ভব। 

Causes and Background of the Crusades

In 1095 AD, Pope Urban II proposed a holy war at the Council of Clermont in France to reclaim the sacred city of Jerusalem from Muslim control. Once this proposal was accepted, a bloody conflict began, lasting for the next 200 years. This war is known as the Crusades. The Pope's followers, the religious warriors, carried the cross on their chests as they participated in the battles, and the cross was also used on the war banners. Hence, this holy war is called the Crusades.

In discussing the background of the Crusades, historian Philip Hitti stated that the Church's cross, the soldiers' swords, and the merchants' wealth collectively gave birth to the Crusades. Jerusalem is the birthplace of Jesus Christ and also the site of Prophet Muhammad's ascension (Miraj). Therefore, Jerusalem was considered a holy place by followers of both religions. Additionally, since it is associated with the memories of Jewish prophets Moses and David, it was also revered by Jews. In the 7th century, Arab Muslims captured Jerusalem. Initially, there was no conflict between Christians and Muslims over this. However, in the 11th century, when the Seljuk Turks came to power, tensions between the two communities began to rise. The Seljuk Turks brutally persecuted pilgrims, and when these atrocities reached Europe, they caused widespread outrage. Furthermore, when Caliph Al-Hakim destroyed Christian holy sites and churches, it deeply hurt the religious sentiments of Christians, prompting them to seek retribution.

In the 11th century, the relationship between the Roman Empire and the Pope had severely deteriorated. However, Pope Urban II, like his predecessor Gregory VII, held absolute authority. His relationship with Greek Christians was also strained. The Pope sought to escape this uncomfortable situation, which required a mass uprising. By inciting Christians to launch a Crusade against Muslims, the Pope could restore his glory and reassert his influence over the Holy Roman Emperor.

There were also significant economic reasons behind the Crusades. The Mediterranean trade routes had long been under Muslim control, which harmed the commercial interests of Italian merchants. These merchants supported and aided the Pope in initiating the holy war. Similarly, a trade crisis had emerged in Europe, severely impacting the economy. In the 10th century, Europe's population growth left many people struggling to make a living. Feudal laws that deprived younger sons of inheritance rights exacerbated the situation, leading to widespread social unrest and creating a disgruntled population. These people joined the Crusades in large numbers.

Economic decline affected all sections of society, but peasants and serfs were the hardest hit. Serfs had long endured the oppression of feudal lords and believed that participating in the holy war would free them from this tyranny. Vagabonds and social outcasts hoped to gain wealth, new lands to settle, and believed that martyrdom would open the gates of heaven for them. On the other hand, feudal lords aimed to increase their power and influence through the Crusades. They anticipated that more wars would lead to the conquest of new territories, resulting in more land and serfs.

The Romans and Greeks took pride in being the bearers of civilization. However, the rise and rapid spread of Islam significantly diminished their influence and shattered their pride. With Islam's dominance established in Asia, Europe, and Africa, the Romans and Greeks felt increasingly cornered. Thus, they joined the Crusades as a final attempt to reclaim their lost glory.

In summary, the entire Christian world was politically, economically, religiously, and culturally cornered. Desperate to escape this situation, they turned to the Crusades, which marked the beginning of this historic conflict.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...