সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পল্লব- চালুক্য দ্বন্দ্ব | Pallava-Chalukya Conflict

পল্লব- চালুক্য দ্বন্দ্ব

গুপ্তোত্তর যুগের রাজনৈতিক ইতিহাসে দক্ষিণ ভারত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করেছিল। উত্তর ভারতে তখন বর্ধন রাজবংশের শাসন ছিল। দক্ষিণ ভারত একাধিক ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত। কিন্তু অপেক্ষাকৃত বৃহৎ রাজশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল কাঞ্চীর পল্লব এবং বাতাপির চালুক্যরা। কৃষ্ণা-তোঙ্গভদ্রা দোয়াব অঞ্চলের উপর অধিকারকে কেন্দ্র করে দু'পক্ষের মধ্যে প্রায় ২০০ বছর ধরে দ্বন্দ্ব চলেছিল। 

দাক্ষিনাত্যে বাতাপিকে কেন্দ্র করে চালুক্যদের আবির্ভাব ঘটেছিল। বাতাপির অবস্থান বর্তমান কর্ণাটকের বিজাপুর জেলায়। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম পুলকেশী (৫৩৬-৫৬৬ খ্রিঃ)। এই বংশের চতুর্থ শাসক ছিলেন দ্বিতীয় পুলকেশী (৬১১-৬৪২ খ্রিঃ) বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক এবং তাঁর রাজত্বকালেই পল্লবদের সাথে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়েছিল। এদিকে পল্লবদের উতপত্তির ইতিহাস আজও রহস্যাবৃত। ষষ্ঠ শতকের শেষ দিকে সিংহবিষ্ণু এই রাজ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের (৬০০-৬৩০ খ্রিঃ) রাজত্বকালেই পুলকেশীর সাথে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়েছিল।

চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী (৬১১-৬৪২ খ্রিঃ) বেঙ্গি জয় করার পর পল্লব রাজা প্রথম মহেন্দ্রবর্মনকে আক্রমণ করেন। এইভাবে চালুক্য-পল্লব দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। প্রথম মহেন্দ্রবর্মন তখন কাঞ্চি দুর্গে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষা করেন. পল্লব লেখ থেকে জানা যায় পাল্লুর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজা প্রথম মহেন্দ্র বর্মন তার রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের উপর আধিপত্য হারান। কিন্তু মহেন্দ্র বর্মনের পরবর্তী শাসক নরসিংহ বর্মন মহামল্ল, যাকে পল্লব রাজবংশের শ্রেষ্ঠ শাসকের মর্যাদা দেওয়া হয়, চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীকে তিনবার যুদ্ধে পরাস্ত করেন এবং ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে চালুক্যদের রাজধানী বাতাপি অধিকার করেন। এই ঘটনার স্মারক হিসাবে তিনি 'বাতাপিকোন্ড' উপাধি ধারণ করেন। দ্বিতীয় পুলকেশীর মৃত্যুর পর পল্লবরা চালুক্য রাজ্যের দক্ষিণস্ত এলাকাগুলির উপর নিজেদের অধিকার কায়েম করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় পুলকেশীর মৃত্যুর ১৩ বছর পর প্রথম বিক্রমাদিত্যের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। এতদিন তাঁকে রাজ্য পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। তাঁকে প্রথম নরসিংহ বর্মন, দ্বিতীয় মহেন্দ্র বর্মন ও প্রথম পরমেশ্বর বর্মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে হৃতসাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে হয়েছিল। 

পল্লবদের সাথে চালুক্যদের শত্রুতায় কোনো বিরতি ছিল না। নরসিংহ বর্মণের পুত্র দ্বিতীয় মহেন্দ্র বর্মন (৬৬৮-৬৭০ খ্রিঃ) মাত্র দু'বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর প্রধান শত্রু হিসাবে চালুক্য রাজ প্রথম বিক্রমাদিত্যের (৬৫৫-৬৮১ খ্রিঃ) নাম উল্লিখিত হয়েছে। চালুক্য তথ্যসূত্রে দাবি করা হয়েছে যে চালুক্যরাজ প্রথম বিক্রমাদিত্য পল্লবদের রাজধানী কাঞ্চি দখল করেছিল। এই সময় পল্লব শাসক ছিলেন প্রথম পরমেশ্বর বর্মন (৬৭০-৬৯৫ খ্রিঃ)। পরমেশ্বর বর্মনকে তিনি কর প্রদানে বাধ্য করেছিলেন।  আবার পল্লব তথ্যসূত্রে দাবি করা হয়েছে যে প্রথম পরমেশ্বর বর্মন ত্রিচিনোপোলির যুদ্ধে প্রথম বিক্রমাদিত্যকে পরাস্ত করেছিলেন। এই পরস্পর বিরোধী দাবির মধ্যে যে সত্যটি উঠে আসে সেটি হল বিক্রমাদিত্য দক্ষিণের ত্রিচিনোপলি পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। সম্ভবত তিনি কাঞ্চি অধিকার করে তার বংশের অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।

নন্দীবর্মণ পল্লবমল্ল (৭৩০-৮০০ খ্রিঃ) একজন পরাক্রমশালী শাসক ছিলেন। তাঁর সময়ে চালুক্য রাজ দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য পল্লব রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন এবং কাঞ্চী অধিকার করেছিলেন। সেই সময় পল্লবরা পাণ্ড্যদের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিল। যদিও নন্দীবর্মন চালুক্য আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, কাঞ্চী পূনরুদ্ধার করেছিলেন। এই চালুক্য রাজা অবশ্য মন্দিরের সব লুন্ঠিত সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। 

দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের পরবর্তী শাসক দ্বিতীয় কীর্তি বর্মনের সময় চালুক্যরা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সময় উত্তর দাক্ষিনাত্যে রাষ্ট্রকুটদের আবির্ভাব হয়। এরা এক সময় চালুক্যদেরই অধীনে শাসন করত।  রাষ্ট্রকূটরা কীর্তি বর্মনসহ একাধিক চালুক্য শাসককে  পরাস্ত করে। ফলে চালুক্যরা রাষ্ট্রকূটদের অধীনতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। অন্য দিকে পল্লবদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে তাঞ্জোরে আবির্ভূত হয় চোল রাজবংশের এবং এরা দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান শক্তি হিসাবে প্রকাশিত হয়। 

Pallava-Chalukya Conflict

In the post-Gupta period, South India played a crucial role in political history. While the Vardhana dynasty ruled North India, South India was divided into several smaller kingdoms. However, two major powers emerged: the Pallavas of Kanchipuram and the Chalukyas of Badami. Their rivalry over the control of the Krishna-Tungabhadra Doab lasted for nearly 200 years.

The Chalukyas first emerged as a powerful dynasty centered around Badami, located in present-day Bijapur district of Karnataka. The dynasty was founded by Pulakeshin I (536-566 CE). The fourth ruler, Pulakeshin II (611-642 CE), is considered the greatest Chalukya ruler, and it was during his reign that the conflict with the Pallavas began.

The origins of the Pallavas remain somewhat mysterious. In the late 6th century, Simhavishnu established the Pallava dynasty. His son, Mahendravarman I (600-630 CE), came into conflict with Pulakeshin II. After conquering Vengi, Pulakeshin II launched an attack on Mahendravarman I, marking the beginning of the Pallava-Chalukya conflict. The Pallava king sought refuge in the Kanchipuram fort. Pallava inscriptions suggest that Mahendravarman I was defeated at the Battle of Pallalur, losing control over the northern part of his kingdom.

However, Mahendravarman I’s successor, Narasimhavarman I Mahamalla, regarded as the greatest Pallava ruler, decisively defeated Pulakeshin II in three battles. In 642 CE, he captured the Chalukya capital, Badami, earning the title "Vatapikonda" (the conqueror of Badami). After Pulakeshin II’s death, the Pallavas extended their influence over the southern territories of the Chalukya kingdom. Thirteen years later, Vikramaditya I was crowned and focused on reclaiming lost Chalukya territories. He had to fight against Pallava rulers Narasimhavarman I, Mahendravarman II, and Parameshvaravarman I to restore Chalukya dominance.

The hostilities between the Pallavas and Chalukyas continued without respite. Mahendravarman II (668-670 CE), son of Narasimhavarman I, ruled for only two years. His primary rival was Chalukya king Vikramaditya I (655-681 CE), who, according to Chalukya records, captured the Pallava capital, Kanchipuram. During this time, the Pallava ruler was Parameshvaravarman I (670-695 CE). The Chalukyas forced him to pay tribute, but Pallava inscriptions claim that he defeated Vikramaditya I at the Battle of Tiruchirapalli. These conflicting claims suggest that Vikramaditya I advanced as far as Tiruchirapalli, possibly even capturing Kanchipuram to avenge the humiliation suffered by his dynasty.

Nandivarman Pallavamalla (730-800 CE) was a powerful Pallava ruler. During his reign, Chalukya king Vikramaditya II invaded Pallava territory and captured Kanchipuram while the Pallavas were engaged in battles against the Pandyas. However, Nandivarman successfully repelled the Chalukya invasion and regained Kanchipuram. Notably, Vikramaditya II returned the looted treasures of Pallava temples after his conquest.

Under Vikramaditya II’s successor, Kirtivarman II, the Chalukyas gradually weakened. During this time, the Rashtrakutas emerged as a dominant power in northern Deccan. Once vassals of the Chalukyas, the Rashtrakutas defeated Kirtivarman II and several other Chalukya rulers, forcing the Chalukyas to acknowledge Rashtrakuta supremacy. Meanwhile, in the south, the Chola dynasty rose to prominence in Thanjavur, eventually becoming the dominant force in South Indian politics.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...