প্রাচীন ভারতে কারিগরি উৎপাদন: খ্রিঃ পূঃ তৃতীয় শতক থেকে খ্রিঃ চতুর্থ শতক | Artisanal Production in Ancient India: From the 3rd Century BCE to the 4th Century CE

প্রাচীন ভারতে কারিগরি উৎপাদন:  খ্রিঃ পূঃ তৃতীয় শতক থেকে খ্রিঃ চতুর্থ শতক 

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত সময়কালে উপমহাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে কুষাণ এবং সাতবাহনদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই পর্বে আমরা অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতির নজির লক্ষ্য করেছি। রাজনৈতিক টানাপোড়েন অবশ্যই ছিল। তবে তা অর্থনীতির উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারেনি; বরং মৌর্য যুগে অর্থনীতিতে যে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল তা মুক্ত হওয়ার ফলে কারিগরি উৎপাদন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য এক নতুন চলমানতা এসেছিল। সমকালীন তথ্যসূত্র থেকে এই অগ্রগতির প্রমাণ পাওয়া যায়।

আলোচ্য পর্বের অন্যতম কারিগরি বৃত্তি ছিল ছুতোরের কাজ। এদের তখন 'বদ্ধকি' বলা হত। জাতকের কাহিনী থেকে জানা যায় বারানসির কাছে একটি গ্রামে প্রচুর সংখ্যায় ছুতোর মিস্ত্রি বসবাস করতেন। কাছাকাছি অরণ্য থেকে কাঠ সংগ্রহ করে নানান দ্রব্য নির্মাণ করে তারা বারানসির বাজারে বিক্রি করতো। বাঁশের কারিগরকে 'বসকার' এবং কঞ্চির কারিগরকে 'কেনাচিক' বলা হত। কাচামালের উৎস একই কিন্তু দু ধরনের কারিগরের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে ওই শিল্পে দক্ষতা ও বিশেষজ্ঞতার প্রমাণ। গন্ধ দ্রব্য তৈরি করতেন যারা তাদের সমকালীন সাহিত্যে 'গন্ধিক' বলা হয়েছে। এরা 'সুবাসক' নামেও পরিচিত ছিলেন। 'মালাকার' মালা গাঁথতেন। ডি. ডি. কোশাম্বী গন্ধ দ্রব্য ও মালা তৈরির শিল্পকে বিলাস উপকরণ হিসেবে দেখেছেন। গ্রীষ্ম প্রধান আদ্র দেশে এই ধরনের সুগন্ধীর ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক। 

প্রাচীন ভারতে প্রধানতম শিল্প বস্ত্র শিল্প। নাসিকের নহপানের একটি লেখতে 'তাঁতি' বা 'কৌলিক'দের কথা আছে। মথুরার একটি লেখতে 'প্রাবরিক' নামে একটি গোষ্ঠীর কথা রয়েছে। এরা সম্ভবত প্রবর নামে এক বিশেষ প্রকার কাপড় তৈরির সাথে যুক্ত ছিল। পেরিপ্লাস থেকে জানা যায় টের ও পৈঠান ছিল দক্ষিণ ভারতের বস্ত্র উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র। খনন কার্যের ফলে টের থেকে রং করার বিশাল আধার পাওয়া গেছে। জাতকে কাপড় রং করাকে একটি পৃথক শিল্প হিসেবে দেখানো হয়েছে। এদের 'রঙ্গকার' বলা হত। তামিলনাড়ুর আরিকামেডুতে এরকম রঞ্জন শিল্পের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। সবচেয়ে দামি ও ভালো কাপড় ছিল মসলিন, যা উজ্জয়িনী, বারানসি এবং বাংলায় তৈরি হত। তবে গ্রিক বিবরণীতে বাংলার উৎকৃষ্ট মসলিনের কথা বলা হয়েছে। 

বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন কারিগরদের মধ্যে কামারদের উল্লেখ রয়েছে। এরা লোহার জিনিস তৈরি করত। পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে বোঝা যায় দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ও কৃষিজ উৎপাদনের লোহার ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছিল। নিত্য প্রয়োজনীয় আরেকটি তৈজস হল কৌলাল। বৌদ্ধ সাহিত্য  এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যে মৃতপাত্রের ব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। 

নিত্য প্রয়োজনীয় শিল্পদ্রব্য ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বিলাস দ্রব্য আলোচ্য পর্বে তৈরি হত; যেমন হাতির দাঁতের জিনিস তৈরি করতেন 'দন্তকার'। টলেমির ভূগোলে বলা হয়েছে দন্তপুরা ছিল হাতির দাঁতের কাজের অন্যতম কেন্দ্র। আফগানিস্তানের বৈগ্রামে হাতির দাঁতের তৈরি দ্রব্যের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া অলংকার শিল্পে 'সুবর্ণকারের' কথা এসেছে। মথুরার একটি লেখতে 'মনিকারে'র কথা বলা হয়েছে, যারা দামী পাথর দিয়ে বিভিন্ন অলংকার বানাতেন। 

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বেশ কিছু কারিগরি উৎপাদন হত। সেগুলির মধ্যে খনি ও খনিজ শিল্প ছিল উল্লেখযোগ্য। টলিমির ভূগোল থেকে জানা যায় কোষা নামক স্থানে হীরের খনি ছিল। এটি সম্ভবত মালবের পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিল এবং এর প্রাচীন নাম ছিল দশার্ণ। সাতবাহন, শক ও কুষানদের লেখতে এই এলাকার উল্লেখ রয়েছে। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখার্জি দেখিয়েছেন হীরের খনি ছিল বলে এই এলাকার নাম কোষা হয়েছিল। লেখমালা থেকে জানা যায় কোষার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য উপরোক্ত তিন শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। 

অপর একটি খনিজ সম্পদ হল বৈদুর্য। টলেমির ভূগোল থেকে জানা যায়, পুনাটা ছিল বৈদুর্যের ভান্ডার। সম্ভবত এটি তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুর এর কাছে অবস্থিত ছিল। মুক্ত চাষের ব্যাপারটিও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকত। তামিলনাড়ুর কোরকাই এলাকায় মুক্ত চাষ হত। পেরিপ্লাসের তথ্য অনুযায়ী পান্ড্য রাজারা মুক্ত উৎপাদন কেন্দ্র গুলি প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করত। মৃত্যুদন্ডজ্ঞা প্রাপ্ত দোষীদের দিয়ে ডুবুরির কাজ করানো হত। 

লবণ উৎপাদনকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা শস্ত্রাকাররা বারবার বলেছেন। তবে শাসকেরা অন্ততপক্ষে এই উৎপাদনের ওপর কর আদায় করতেন। সাতবাহনদের সময়ে অগ্রাহার দানে লবণের উপর কর ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এর থেকে বোঝাই যায় লবণ কর আদায়ের রীতি ছিল। তিনি মন্তব্য করেছেন, সল্ট রেঞ্জ থেকে যে পরিমাণ শুল্ক আদায় হয় তা একটি হীরের খনির আয়ের থেকেও বেশি। 

সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে আলচ্য পর্বে কারিগরি উৎপাদনে ব্যক্তিগত উদ্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তা সম্ভব হয়েছিল রাজকীয় নিয়ন্ত্রনের হ্রাস পাওয়ার ফলে। আর এজন্যই কারিগরি উৎপাদন বৈচিত্র্যে ও পরিমানে বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছিল। 

Artisanal Production in Ancient India: From the 3rd Century BCE to the 4th Century CE

Between the 3rd century BCE and the 4th century CE, the Kushanas and Satavahanas dominated the political landscape of the Indian subcontinent. This period witnessed significant advancements in various economic sectors. Although political conflicts existed, they did not adversely affect the economy. On the contrary, with the relaxation of state control over the economy, which had been prominent during the Mauryan era, artisanal production and trade gained new momentum. Contemporary sources provide evidence of this progress.

One of the most notable artisanal professions during this period was carpentry. Carpenters were referred to as badhaki. According to the Jataka tales, a village near Varanasi had a large community of carpenters who collected timber from nearby forests, crafted various items, and sold them in the markets of Varanasi. Bamboo artisans were called baskara, and those specializing in cane work were known as kenachika. Although they shared the same raw material source, the existence of distinct craftsmen indicates a high degree of specialization. Perfume makers were referred to as gandhika in contemporary literature, also known as subasaka. Similarly, malakara were garland makers. Historian D.D. Kosambi classified the industries of perfume and garland-making as luxury trades, which is understandable given the humid climate of India, where fragrances were widely used.

The textile industry was the most prominent sector in ancient India. An inscription from Nasik mentions tantis or kaulikas (weavers). Another inscription from Mathura refers to a guild called pravarika, possibly associated with the production of a special type of fabric known as pravar. According to the Periplus of the Erythraean Sea, Ter and Paithan were major centers of textile production in South India. Excavations in Ter have revealed large dyeing vats, confirming the presence of a dyeing industry. The Jataka tales also describe dyeing as a distinct trade, referring to dyers as rangakara. Archaeological evidence of such dyeing industries has been found at Arikamedu in Tamil Nadu. The most valuable and sought-after fabric was muslin, produced in Ujjain, Varanasi, and Bengal. Greek sources specifically mention the superior quality of muslin from Bengal.

Among highly skilled artisans, blacksmiths were significant. They produced iron tools and objects. Archaeological evidence suggests that iron usage in daily life and agricultural production was increasing during this period. Another essential craft was pottery. Buddhist literature and archaeological findings indicate widespread and diverse use of earthenware.

In addition to essential goods, various luxury items were also produced during this period. Dantakara were ivory carvers, and according to Ptolemy’s Geography, Dantapura was a major center for ivory craftsmanship. Archaeological evidence of ivory artifacts has been found in Begram, Afghanistan. The jewelry industry was also prominent, with references to suvarnakara (goldsmiths) and manikara (gem artisans) in inscriptions from Mathura.

The state also played a role in artisanal production, particularly in the mining and mineral industries. Ptolemy’s Geography mentions a place called Kosha, known for its diamond mines, likely located east of Malwa, in the ancient region of Dasharna. The inscriptions of the Satavahanas, Shakas, and Kushanas mention this area. Historian B.B. Mukherjee suggested that the name Kosha originated from its association with diamond mining. The control over this region was a matter of contention among these three powers.

Another important mineral resource was vaidurya (beryl). According to Ptolemy, Punata was a significant source of beryl, possibly located near present-day Coimbatore in Tamil Nadu. The pearl industry was also under state control, particularly in the Tamil Nadu region of Korkai. According to the Periplus, the Pandya rulers directly managed pearl fisheries. Convicts sentenced to death were sometimes employed as pearl divers.

Salt production was another industry under state control. Ancient texts frequently mention taxation on salt production. During the Satavahana period, tax exemptions were granted for salt in agrahara donations, suggesting that a tax system for salt was in place. One historian remarked that the revenue collected from the Salt Range in present-day Pakistan exceeded that of a diamond mine.

From the above discussion, it is evident that private enterprise in artisanal production increased during this period, largely due to the reduction of state control. This led to an unprecedented expansion in the variety and volume of artisanal production.