সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ম্যানর ব্যবস্থার স্বরূপ | Manorialism

ম্যানর ব্যবস্থার স্বরূপ 

উৎপাদন ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার জন্য সমাজের নিচুস্তরে প্রভূ ও অধীনস্থ প্রজার সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে যে প্রাচীনতর ও দীর্ঘায়ু প্রতিষ্ঠান ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোতে স্বাভাবিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তা 'ম্যানর' নামে পরিচিত। ম্যানারগুলিকে ফ্রান্সে অবশ্য সেঁইন্যারি (Seigneurie) বলা হত। মার্ক ব্লকের ভাষায়, ম্যানর ছিল প্রধানত এস্টেট, যার সীমানার মধ্যে বাস করতেন লর্ডের প্রজারা। আর লর্ড বা ভূস্বামীর জমিতে প্রজা কর্তৃক উৎপাদিত খাদ্যশস্যের ভাগীদার হাওয়াই ছিল লর্ডের কর্তৃত্ব প্রয়োগের মূল লক্ষ্য। অধীনস্থ প্রজার উপরে ভূস্বামীর অধিকারের মাত্রা ও ব্যাপকতার বিচারে ম্যানর গুলিকে সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার স্থানীয় বিভাগ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

সাধারণত আকারে বিশাল এবং স্বনির্ভর এই প্রতিষ্ঠান ইউরোপের সর্বত্র একইভাবে বা একই সময়ে গড়ে ওঠেনি। কোথাও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণরূপে ম্যানর নিয়ন্ত্রিত, কোথাও অসংখ্য ছোট ছোট ক্ষেত মালিক বিচ্ছিন্নভাবে কৃষিকাজ সম্পন্ন করতেন। জার্মানি ও ইংল্যান্ডের বহু আগেই ফ্রান্স ও ইতালিতে কয়েকটি এলাকায় ম্যানর ব্যবস্থার বিকাশ লক্ষ্য করা গেছে। ফ্রান্সে শার্লমানের রাজত্বকালেই ল্যয়র ও ম্যেজ নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বড় বড় খামার গড়ে উঠেছিল। নবম শতকের মধ্যেই গল দেশের উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব দিকের এলাকায়, সমগ্র ইতালিতে, ক্যাটালোনিয়ে, রাইনল্যান্ড, মধ্য ও দক্ষিণ জার্মানিতে ম্যানরই হয়ে ওঠে মধ্যযুগীয় উৎপাদন ব্যবস্থার মূল উৎস। ইংল্যান্ড ও ডেনমার্কের এই ব্যবস্থার পতন হয় দশম শতকে। গল দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাংশে এবং স্যাক্সনীর সমতল ভুমিতে কৃষক পরিচালিত ছোট ছোট খামারের উপস্থিতি ছিল, যেগুলিকে allod বলা হত। এখানে ম্যানর গড়ে ওঠেনি।

শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে ম্যানর ছিল জমিদারের ভূসম্পত্তি। এর আয়তন হত অন্ততপক্ষে একজন সম্পন্ন কৃষকের ক্ষেত খামারের থেকে বড়। ম্যানরের সীমানার মধ্যে শুধুমাত্র ভূস্বামীর খেত খামার ও বাসগৃহই থাকত না। এখানকার কৃষিযোগ্য জমিখন্ড কৃষক প্রজাদের মধ্যে বিলি বন্দোবস্ত করে দেওয়া হতো। ম্যানারে যে পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন হত, তার মধ্যে কর্ষণযোগ্য জমি এবং স্বাভাবিক অর্থনীতির প্রধান ভূমিকা ছিল। শ্রম বা শ্রমলব্ধ উৎপাদনকে পণ্য হিসাবে এখানে গ্রাহ্য করা হতো না। উৎপাদনে যার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল সেই কৃষক ছিল উৎপাদনের মাধ্যম এবং একটি নির্দিষ্ট সামাজিক সূত্রে ভূমির সঙ্গে সে ছিল আবদ্ধ। এরাই ছিল ভুমিদাস। ম্যনরের মধ্যে যে জমিতে কৃষকরা বসবাস করত বা যেখানেই কৃষিকাজ সম্পন্ন হতো তার ওপর তাদের মালিকানা থাকত না। এই জমির উপরে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকত ম্যানরের প্রভুর। তারা তাদের অধিকার প্রয়োগ করে কৃষক-ভূমি দাসদের কাছ থেকে উৎপন্ন শস্যের বেশিরভাগটাই ভোগ করতেন। তাছাড়া ভূমিদাস কৃষকরা প্রভুর জন্য বিভিন্নভাবে শ্রম দানে বাধ্য থাকত। প্রভূর খাস জমিতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কৃষি উৎপাদনে নিযুক্ত থাকা তাদের কাছে বাধ্যতামূলক ছিল। সুতরাং ম্যানরের জমি থেকে ভূস্বামীর দুই প্রকার আয় হত- ভূস্বামীর নিজস্ব বা খাস জমি থেকে এবং অধীনস্থ প্রজাদের প্রদেয় রাজস্ব থেকে।

খাস জমিতে শস্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে গেলে প্রভূকে নির্ভর করতে হত কৃষক প্রজাদের শ্রমের উপর। তাই অনেক ক্ষেত্রে কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থা নির্ভর করত লর্ডের জমিতে শ্রমের চাহিদার উপর। এর ফলে কৃষক তার সামাজিক স্বাধীনতা হারাত। ভূমিদাস-কৃষকেরা জীবিকা নির্বাহের জন্য জমিতে আবদ্ধ থাকত এবং ভূস্বামীর প্রাপ্য রাজস্ব ও 'বেগার' দিত। কতটা বেগার দিতে হবে তার কোনো লিখিত চুক্তি হত না। তা নির্ভর করত ম্যানরের রীতিনীতি এবং সেই রীতিনীতির প্রভূ কর্তৃক ব্যখ্যার উপর। ভূমিদাসরা তাদের জন্মগত অধিকারগুলি যেমন বসতি স্থানান্তর, বিবাহ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় এমনকি রাজকীয় বিচারালয়ের দ্বারস্ত ইত্যাদি অধিকার গুলি ভুমিদাস-কৃষক ম্যানর প্রভূর সম্মতি ছাড়া ভোগ করতে পারত না। এবং এর জন্য তাকে অর্থদন্ড দিতে হত। এর ফলে ভূস্বামী-প্রভূ ভূমিদাস-কৃষকদের উপর শাসন ও বিচার ক্ষমতার অনেকাংশ লাভ করেছিল। স্থানীয় শান্তিরক্ষা, ফৌজদারি আইন প্রয়োগ, বিচারালয়ের অধিবেশন, জুরি নিয়োগ -এসব দায়িত্ব তথা ক্ষমতাগুলি প্রভূ ভোগ করতেন।   

Manorialism

To maintain the production system, the earliest and enduring institution based on the relationship between lords and subordinate peasants at the grassroots level of society was naturally integrated into Europe’s feudal structure. This institution is known as the "manor." In France, however, manors were called seigneurie. According to Marc Bloch, a manor was primarily an estate where the lord's peasants resided within its boundaries. The main purpose of the lord's authority was to share in the agricultural produce cultivated on the lord’s land by the peasants. Depending on the extent and nature of the lord's rights over the subordinate peasants, manors were considered the local units of the feudal system of governance.


Typically large and self-sufficient, these institutions did not develop uniformly or simultaneously across Europe. In some places, agricultural production was entirely manor-controlled, while in others, numerous small, individually owned fields coexisted. The development of the manor system can be observed in certain areas of France and Italy long before it appeared in Germany and England. During Charlemagne’s reign, large estates emerged between the Loire and Meuse rivers in France. By the ninth century, manors became the primary source of medieval production in northeastern and southeastern regions of Gaul, across all of Italy, Catalonia, the Rhineland, and central and southern Germany. In England and Denmark, this system declined in the tenth century. In southwestern Gaul and the Saxony plains, small, farmer-managed estates called allods existed, where the manor system did not emerge.


From an economic perspective, a manor was essentially the landlord's estate, typically larger than a prosperous farmer's fields. Within the manor’s boundaries were not only the lord’s fields and residence but also arable lands allocated to the peasants. Agricultural production within manors relied on cultivable land and a subsistence economy. Labor or labor-produced goods were not treated as commodities. The peasants, who directly contributed to production, were tied to the land by a specific social arrangement. These peasants were the serfs. They had no ownership of the land they lived on or cultivated; the lord of the manor had complete control over this land. By exercising their authority, the lords claimed a large share of the crops produced by the serfs. Moreover, the serfs were obligated to provide various forms of labor for the lord. Working on the lord’s demesne for a specified period was mandatory for them.


Thus, the landlord derived two types of income from the manor: the produce from his own or demesne land and the revenue provided by subordinate peasants. To ensure uninterrupted production on the demesne, the lord relied on the labor of serfs. As a result, the economic condition of the peasants often depended on the labor demands of the lord's land. This situation deprived the peasants of their social independence. Serfs remained bound to the land for their livelihood and were required to pay dues and provide begar (unpaid labor) to the lord. The extent of this unpaid labor was not determined by any written agreement but depended on the customs of the manor and the lord’s interpretation of those customs.


Serfs could not exercise their hereditary rights—such as changing residence, marriage, inheritance, buying and selling property, or appealing to the royal courts—without the lord's consent, for which they often had to pay fines. This granted the lords extensive authority over the serfs, including governance and judicial powers. Responsibilities such as maintaining local peace, enforcing criminal laws, holding court sessions, and appointing juries were privileges enjoyed by the lords.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...