তুং চি পুনস্থাপন
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মাঞ্চু রাজতন্ত্রের অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। পশ্চিমী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি চীনের অধিকাংশ অঞ্চল গ্রাস করেছিল ফেলেছিল। ব্রিটিশ ও ফরাসি সৈন্যরা মাঞ্চু রাজাদের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ অগ্নিদগ্ধ করেছিল। তার ওপর বিভিন্ন রাজতন্ত্র বিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহ (যেমন- তাইপিং, মিয়াও, নিয়েন, তুংগান ও মুসলিম বিদ্রোহ) মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এই প্রেক্ষাপটে চীনা সম্রাট তুং চি-এর রাজত্বকালে (১৮৬২-১৮৭৪) বিলুপ্তপ্রায় রাজশক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটা আন্তরিক প্রয়াস চালানো হয়েছিল। এই প্রয়াস তুং চি পুনঃ প্রতিষ্ঠা নামে পরিচিত।
সম্রাট তুং চি'র নামে এই প্রক্রিয়ার নামকরণ হলেও এই ব্যাপারে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না; কারণ তখন তার বয়স ছিল অত্যন্ত কম। রাজ মাতা জু-শি তার অভিভাবক হিসাবে রাজকার্য পরিচালনা করতেন।রাজশক্তির পুনরুদ্ধারে উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল পূর্ববর্তী সম্রাট সিয়াং ফেং- এর ছোট ভাই রাজকুমার কুং এবং তার অনুগামী একদল রাজপুরুষের।
তুং চি পুনঃ প্রতিষ্ঠার নেত্রীবর্গ অধিকাংশই ছিলেন কনফুসীয় মতাদর্শে বিশ্বাসী। তারা একটি স্থিতিশীল কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। মেইজি জাপানের মতো তারা বাণিজ্য নির্ভর আধুনিক অর্থনীতি গড়ে তোলার পথে হাটেননি। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ও জনগণের জীবিকার মধ্যে তারা একটি সামঞ্জস্য বিধান করতে চেয়েছিলেন মাত্র।
ক) কৃষি জমির সম্প্রসারণ
যুদ্ধ ও বিভিন্ন গণঅভ্যুত্থানের ফলে চীনের কৃষিকাজের ব্যাপক অবনতি ঘটেছিল। বিদ্রোহ কবলিত এলাকাগুলি থেকে গ্রামীণ জনসাধারণ পালিয়ে যেতে শুরু করেছিল। তাই তুং চি কর্তৃপক্ষ কৃষি উন্নতিকল্পে সেচ প্রকল্প গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগ নেন। পলাতক কৃষকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। বহু নতুন জমি কৃষির আওতায় আসে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় কিউচিয়াং এবং কিয়াংসি অঞ্চলের জনসংখ্যা মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ৮ হাজার থেকে বেড়ে হয় ৪০ হাজার। কৃষকদের কৃষি সরঞ্জাম ও বীজ কেনার জন্য সরকারি ঋণ দেবার ব্যবস্থা করা হয়। এমন কি বেশ কিছু জেলায় খাজনার হার উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশ করা হয়।
কনফুসীয় মতাদর্শ অনুসারে জমির ওপর কৃষকের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু তুং চি কর্তৃপক্ষ সর্বত্র সেই আদর্শের বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কারণ বিতাড়িত জমিদাররা তাদের পুরনো এলাকায় পুনরায় ফিরে এসে বলপূর্বক কৃষকদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিতে থাকে। সরকারি আমলা এবং উচ্চ পদস্থ কর্মচারীগণ অনেক ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হয়ে ওঠেন এবং ভাড়াটে চাষীদের কাজে লাগায়।
খ) জনকল্যাণমূলক কার্যাবলী
যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকা গুলিতে তুং চি কর্তৃপক্ষ পুনঃনির্মাণ সংক্রান্ত কার্যালয় গড়ে তোলেন। এর প্রাথমিক কাজ ছিল শহরের ধ্বংসপ্রাপ্ত পাঁচিল ও মন্দিরগুলিকে পুনর্নির্মিত করা। তবে এই কার্যালয় কৃষির উন্নতির জন্য এবং সুস্থ গ্রাম জীবন গড়ে তোলার জন্য জল ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ইয়েলো নদীর বাঁধ গুলির পুনর্নির্মাণ হয়েছিল। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় বন্যা হলে বন্যা পীড়িতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বন্যা নিয়ন্ত্রণের একাধিক ব্যবস্থা সত্ত্বেও কোন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাছাড়া এই কার্যালয় স্থানীয় জেন্ট্রিদের সহায়তায় শস্যভান্ডার গুলি পুনর্গঠিত করেছিল।
গ) ভূমিকর হ্রাস
উনিশ শতকের চীনে একাধিক গণবিদ্রোহের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল মাত্রাতিরিক্ত করের বোঝা। তুং চি কর্তৃপক্ষ এই সমস্যার কথা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তারা প্রায় ৩০ শতাংশ করভার লাঘব করেছিলেন এবং বন্যা ও খরা পীড়িত অঞ্চলে খাজনা মুকুব করার নিয়ম চালু করেছিলেন। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রকাশিত একটি রাজকীয় নির্দেশ নামায় এই নতুন কর ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু নতুন কর ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। হ্রাসপ্রাপ্ত করের তালিকা নথিভুক্ত করা হয়নি। তাই অনেক সময় স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট ও স্থানীয় জেন্ট্রিরা এই অবস্থার সুযোগ নিত এবং বর্ধিত হারে কর আদায় করত। যেমন- কিয়াংসু প্রদেশে ভাড়াটে চাষীদের ওপর খাজনার হার কমানো হয়নি ।
ঘ) অর্থনৈতিক নীতি
পুনঃ প্রতিষ্ঠার সাথে যুক্ত রাজ পুরুষেরা জনগণের জীবিকা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু তা সমাধানের জন্য কোন পরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তারা যেহেতু কনফুসিও মতাদর্শের উপর জোর দিয়েছিলেন তাই বাণিজ্যিক উন্নতির কথা চিন্তা করেননি। রাজপুরুষদের একাংশের অবশ্য দাবি ছিল লিজিন নামে বাণিজ্য শুল্ক তুলে দেয়া হোক। তবুও এই শুল্ক বাতিল করা হয়নি। কারণ তা স্থানীয় শাসনকর্তা ও গ্রামীণ জেন্ট্রিদের কাছে ছিল বিরাট লাভজনক। কিন্তু লিজিন আদায়ের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হলে বা দুর্নীতি হলে তার শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছিল। তুং চি কর্তৃপক্ষ আধুনিক শিল্প গড়ে তোলার কথা কখনো চিন্তা করেননি। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কিছু প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। বাষ্পীয় জাহাজ ও উপকূলবর্তী জলপথ ব্যবহারের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বাষ্পীয় ইঞ্জিন নির্মাণ কারখানা চায়না মার্চেন্টস্ স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি খোলা হয়েছিল। বণিকরা অনেক সময় লিজিন নামক করের হাত থেকে রক্ষা পেতে জলপথ ব্যবহার করতেন।
ঙ) মতাদর্শগত দিক
তুং চি কর্তৃপক্ষ যেহেতু কনফুসীয় মতবাদকে ভিত্তি করেই এগিয়েছিল, তাই একদিকে তারা রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে নিরঙ্কুশ করে তুলতে আমলাতন্ত্রের উন্নতির দিকে নজর দিয়েছিল। অন্যদিকে কনফুসীয় মতাদর্শের ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে জনগণের আনুগত্য বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেছিল। তাদের ধারণা হয়েছিল যে কেবল আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের উন্নতি সম্ভব নয়, উচ্চপদস্থ আমলারা যেন গুনসম্পন্নও হয়। এইজন্য আমলা নিয়োগের ক্ষেত্রে পরীক্ষা ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়েছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল কনফুসিও নীতিবোধে অনুপ্রাণিত উচ্চশিক্ষিত যুবকদের সরকারি চাকরি দেওয়া। একটি নির্দেশ নামায় বলা হয়েছিল যে সরকারি পরীক্ষায় সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ওপর প্রশ্ন করা হবে, যার থেকে পরীক্ষার্থীর নীতিবোধ এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা যাচাই করা যাবে। অন্যদিকে তারা ছেয়েছিল, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে কেবল কনফুসীয় শিক্ষায় বিরাজ করবে। তার জন্য পাঠক্রম থেকে কনফুসীয় বিরোধী সমস্ত বিষয় বাদ দেয়া হল এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যেও চীনা ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির বিস্তার ঘটনার চেষ্টা করা হলো। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব, সনাতন মূল্যবোধ এবং চীনা ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কোন প্রশ্ন তোলাকে ভালো চোখে দেখা হত না।
পরিশেষে বলা যায় তুং চি পুনঃপ্রতিষ্ঠার কর্মসূচিগুলি আদ্যোপান্ত রক্ষণশীল। এখানে কনফুসীয় ভাবধারার বাইরে গিয়ে শিল্প স্থাপন এবং বাণিজ্যিক উন্নতির মাধ্যমে আধুনিকতার কোন প্রচেষ্টা করা হয়নি। জনগণের অধিকার গুলিকে আরও সংকুচিত করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি লাভবান হয়নি। সমাজের কোন অংশের যদি কোন লাভ হয়ে থাকে তা হল জেন্ট্রি গোষ্ঠী। তুং চি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তারা নিজেদের সম্পত্তি বহুগুণ বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল।
ধন্যবাদ স্যার।
উত্তরমুছুন