চিনে মুক্ত দ্বার নীতি
পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি মাঞ্চু রাজতন্ত্র শাসিত চীনে যে সমস্ত শোষণ মূলক পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছিল তার চূড়ান্ত পরিণতি হল চীনের মুক্তদ্বার নীতি (১৮৯৯) । আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন বিদেশ সচিব জন হে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে এই নীতি ঘোষণা করেছিলেন। এই নীতি তাই "হে ডকট্রিন" নামেও পরিচিত। এই নীতির মূল বক্তব্য ছিল:
১. পশ্চিমী শক্তিগুলির প্রভাবাধীন অঞ্চলের স্থানীয় শাসন ব্যবস্থায় তারা হস্তক্ষেপ করবে না।
২. মুক্ত বন্দর গুলিতে চীনের শুল্ক বিভাগ চুক্তি অনুযায়ী কর আদায় করবে এবং এই বিষয়ে বিদেশীরা হস্তক্ষেপ করবে না।
৩) প্রভাবাধীন অঞ্চলে কোনো বিদেশি শক্তি অন্য দেশের বাণিজ্যিক পণ্যের উপর বৈষম্য মূলক শুল্ক চাপাবে না।
৪) হে একটি দ্বিতীয় সড়কপত্র প্রকাশ করে বলেন যে, পশ্চিমী শক্তিগুলির চীনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষা করে চলবে।
মুক্তদ্বার নীতির পশ্চাতে একটি সুনির্দিষ্ট পটভূমি ছিল। মাঞ্চু রাজতন্ত্র তাইপিং বিদ্রোহ দমনের পর যখন চীনের অভ্যন্তরে নিজেকে শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছিল তখন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি চীনকে নিজ নিজ প্রভাবাধীন এলাকায় ভাগ করে নেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছিল। ব্রিটেন চেয়েছিল কাশগড় অঞ্চলকে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। তাই তারা ইউনান অঞ্চলের মুসলিম বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল। এদিকে রাশিয়ার ইচ্ছা ছিল ইলি অঞ্চলের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করা। আমেরিকা কখনোই চায়নি চিন ও জাপানের মধ্যে কোন মিত্রতা গড়ে উঠুক। তাই আমেরিকা জাপানকে তাইওয়ান আক্রমণের জন্য উৎসাহিত করছিল। ব্রিটেনও চাইছিল যাতে জাপান দূরপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে উঠে আসুক। ইতিমধ্যে ব্রিটেন ব্রহ্মদেশ দখল করে এবং ফ্রান্স ভিয়েতনামে উপনিবেশ স্থাপন করে। ভিয়েতনামের ওপর ফ্রান্সের দখলদারির বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে" ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ ভলেন্টিয়ার্স " নামে একটি চীনা স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা ভিয়েতনামের হয়ে লড়াই করেছিল করেছিল। এর প্রতিশোধ নিতে ফ্রান্স ফুচাও বন্দরে আক্রমণ চালিয়ে প্রচুর চীনা নাগরিককে হত্যা করে। ফরাসিদের চাপে চীন ভিয়েতনামের ওপর এবং ব্রিটেনের চাপে নেপালের ওপরে যাবতীয় অধিকার গুলি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর কোরিয়ার ওপর অধিকার কে কেন্দ্র করে চীন- জাপান যুদ্ধে চীনের শোচনীয় পরাজয় হয়, যা বিদেশি শক্তি গুলির কাছে চীনের ব্যবচ্ছেদ করার সুযোগ প্রস্তুত করে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি নিজেদের প্রভাবাধীন হিসাবে যে এলাকাগুলি চিহ্নিত করেছিল সেগুলি হল- ইয়াংসি উপত্যকায় ব্রিটেন, মাঞ্চুরিয়া ও মোঙ্গলিয়ায় রাশিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম চীনে যৌথভাবে ব্রিটেন ও ফ্রান্স, ফুকিয়েন এ জাপান এবং শানটুং প্রদেশ প্রদেশে জার্মানির আধিপত্য। এই তালিকায় কোথাও আমেরিকার নাম ছিল না। কিন্তু আমেরিকার ইচ্ছা ছিল এই বিশাল বাজারে নিজের জায়গা করে নেওয়া তথা প্রশান্ত মহাসাগরকে একটি আমেরিকান হ্রদে পরিণত করা। আমেরিকা তাই কূটনৈতিক পদ্ধতিতে মুক্তদ্বার নীতি ঘোষণা করে চীনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার নামে চীনে বাণিজ্য করার অধিকার স্থাপন করে। তাই ঐতিহাসিক ওয়েন ল্যাটিমোর রসিকতা করে "মুক্তদ্বার নীতি" কে "Me too policy" আখ্যায়িত করেছেন।
মুক্তদ্বার নীতি কোনোভাবেই চীনের স্বার্থের কথা ভেবে হয়নি। কারণ কখনো চীনকে জিজ্ঞেস করা হয়নি বা এ বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া হয়নি তারা মুক্তদ্বার নীতি চায় কিনা। সুতরাং মুক্তদ্বার নীতি সম্পূর্ণরূপে আমেরিকার বাণিজ্যিক স্বার্থে গৃহীত একটি পদক্ষেপ। ব্রিটেনসহ অন্যান্য পশ্চিমী শক্তি গুলি মুক্তদ্বার নীতি কে মেনে নিয়েছিল; কারণ তাদের কারোর পক্ষেই এককভাবে সমগ্র চীন সাম্রাজ্য দখল করা সম্ভব ছিল না, এবং এই নীতির ফলে প্রত্যেকটি শক্তি একে অপরের দ্বারা চীন থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্তি পেয়েছিল।
Thank you sir.
উত্তরমুছুন