সামন্ততন্ত্রের প্রকৃতি
নবম ও দশম শতকে ইউরোপে কেন্দ্রীয় শাসন ভেঙে পড়লে ভূমিনির্ভর অভিজাত ও সরকারি কর্মচারীরা রাজতন্ত্রের বদলে এক ধরনের বিকল্প রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলে যার নাম সামন্ত প্রথা। ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভাঙনের মধ্য দিয়ে সামন্ত ব্যবস্থার উৎপত্তি হয় এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার পূনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থার অবসান হয়। মোটামুটি ৮০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে প্রায় ৫০০ বছর ধরে এই ব্যবস্থা ইউরোপে স্থায়ী ছিল।ইংরাজিতে Feudalism শব্দের বাংলা অনুবাদ হল সামন্ততন্ত্র। 'ফিউড' কথার অর্থ জমি। অর্থাৎ এই ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে জমিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি ব্যবস্থা। সামন্ততন্ত্র মূলত একটি সরকারি ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীয় প্রশাসন থাকে না, ভুস্বামীদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত থাকে। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ধনী অভিজাতরা অধীনস্থদের রক্ষার দায়িত্ব নিত এবং বিনিময়ে অধীনস্থ ব্যাক্তি প্রভুকে সেবা ও সীমাহীন আনুগত্য দিত। প্রভু ও অধীনস্থের এই সম্পর্কই ছিল সামন্ত ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। মার্ক ব্লখ মনে করেন ভ্যাসালেজ (প্রভূ ও অধীনস্থের মধ্যে চুক্তি) এবং ফিফ (জমিখন্ড) এর যৌথ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট এবং ইনভেস্টিচারের মধ্য দিয়ে অনুমোদিত রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই ছিল সামন্ততন্ত্র। ঐতিহাসিক গ্যানসঁফ তাঁর 'ফিউডালিজম' গ্রন্থে সামন্ততন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, মধ্যযুগে ইউরোপে লর্ড ও ভ্যাসালের মধ্যেকার সম্পর্ককে কেন্দ্র করে যে ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছিল তাকে সামন্ততন্ত্র বলা যায়।
সামন্ত প্রথা হলো এমনই এক বদ্ধ উৎপাদন ব্যবস্থা যার প্রধান ভিত্তি হল কৃষিজ উৎপাদন। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর গথ, ভ্যান্ডল, ফ্র্যাঙ্ক প্রভৃতি বর্বর জাতিগুলি পশ্চিম ইউরোপের অঞ্চলগুলি অধিকার করে বসে এবং রাজার মতো তারা জমির অধিকার দাবি করে। এরা এদের জাত ভাইদেরও জমি বন্টন করে। এই জমি বন্টন প্রথম দিকে ব্যক্তিগত হলেও পরে বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে। এইভাবে যারা জমি লাভ করল তারা রাজাকে বা তাদের প্রধানকে সামরিক শক্তি এবং কর দিতে বাধ্য থাকত। এই জমি খণ্ডগুলিকে ফিউড, এবং ফিউডের অধিকারীকে ফিউডাল বা সামন্ত বলা হত। তাই এই উৎপাদন ব্যবস্থা ফিউডালিজম বা সামন্ত প্রথা নামে পরিচিত। সুতরাং সামন্তপ্রথায় তিনটি সামাজিক শ্রেণী লক্ষ্য করা যায়: পিরামিডের শীর্ষে রাজা, দ্বিতীয় স্তরে বহু সংখ্যক সামন্ত প্রভু এবং তৃতীয় স্তরে কৃষক, সার্ফ, ব্যারন আর নাইট।
সামন্ততন্ত্র রাজতন্ত্রকে ধ্বংস করলেও সামন্ত ব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন রাজাই। রাজা ছিলেন জমি, শাসন ও বিচার ব্যবস্থার প্রধান। তিনি এই সমস্ত অধিকার তুলে দেন ভূস্বামীদের হাতে, ভূস্বামীরা ভ্যাসালদের হাতে। এই ব্যবস্থায় আসলে রাজা ছাড়া আর সকলেই ছিলেন ভ্যাসাল। ভ্যাসল তার লর্ড-এর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আনুগত্য বা বিশ্বস্ততার শপথ নিতেন। কোনো পক্ষ শপথ বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে নৈতিক অপরাধে অপরাধী গণ্য হতেন। শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে ধর্মগ্রন্থ ও চার্চকে সাক্ষী রাখা হতো। বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনা ঘটলে লর্ড ভ্যাসালের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে পারতেন। একজন ভ্যাসাল একাধিক লর্ড রাখতে পারতেন তবে সে একজনকে প্রধান লর্ড হিসাবে বেছে নিতেন।
লর্ড এবং ভ্যাসালের সম্পর্ক ছিল চুক্তি নির্ভর। লর্ড ভ্যাসালের ফিফ বা ভূমিখন্ড রক্ষা করবেন। যুদ্ধ, শাসন ও বিচারের ক্ষেত্রে সাহায্য দেবেন। বিনিময়ে ভ্যাসাল দেবেন কর, সেবা ও সামরিক সাহায্য। একজন শর্ত ভাঙলে অপরের আর দায়িত্ব থাকবে না। লর্ড ভ্যাসালের ফিফ পরিদর্শনে গেলে ভ্যাসাল তার জন্য খাদ্য ও বাসস্থানের দায়িত্ব নেবে। ভ্যাসাল লর্ডের আদেশ অমান্য করলে লর্ড অন্যান্য ভ্যাসালদের নিয়ে বিদ্রোহী ভ্যাসালকে আক্রমণ করবে। ভ্যাসাল লর্ড কে যা অর্থ দিতেন তা কর হিসেবে দিতেন না, দিতেন অনুদান হিসাবে। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজা অর্থ দাবি করতে পারতেন। এছাড়া ভ্যাসালকে উত্তরাধিকার কর বা রিলিফ দিতে হতো। উভয়ের মধ্যে এই চুক্তি ভ্যাসালেজ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক Mark Bloch বলেছেন ভ্যাসালেজ এবং ফিফ এই দুইয়ের যৌথ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট রাজনৈতিক-সামরিক ব্যবস্থাই ছিল সামন্ত প্রথা।
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল ম্যানর ব্যবস্থা। ম্যানর ব্যবস্থা এমনই এক আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে ভুমিধিকারী সামন্তপ্রভু তার ম্যানর বা মৌজার অন্তর্গত সমস্ত ভূমিদাস বা কৃষকদের উপর বিভিন্ন রকম অধিকার ভোগ করে। অর্থ সংক্রান্ত, বিচার সংক্রান্ত এবং শাসন সংক্রান্ত সমস্ত অধিকারই তার হাতে থাকে। বিনিময়ে ভূমিদাস পায় বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা এবং ম্যানরের অন্তর্গত জমিতে বসবাস করা ও জীবনধারণ করার অধিকার। মার্ক ব্লক মনে করেন ম্যানর ব্যবস্থা সামন্ত প্রথার অঙ্গ নয়, তবে এটিই ছিল সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির মূল ভিত্তি।
ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের কোন প্রকৃতিগত সাযুজ্য ছিল না। এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে তার বৈসাদৃশ্য ঐতিহাসিক মহলে বিতর্কে সৃষ্টি করেছে। মার্ক ব্লক মনে করেন প্রকৃত সামন্ততন্ত্র কেবল প্রাক্তন ক্যারোলিঞ্জিয় সাম্রাজ্যেই অর্থাৎ বর্তমানে ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি ও মধ্য-পশ্চিম ইউরোপে দেখা যায়। অন্যত্র ছিল সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। কেবল ইংল্যান্ডে নর্ম্যান বিজয়ের পর সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল। অন্যান্য জায়গার ঐতিহাসিক গবেষণায় সামন্ততান্ত্রিক সমাজ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ সেখানে ফিফ ও ভ্যাসালেজ, যা সামন্ততন্ত্রের মূল ভিত্তি, তা কখনোই ততটা গুরুত্ব পাইনি, যতটা ফ্রান্সে পেয়েছিল।
সামন্ততন্ত্রে আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের কারণ ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর উত্থান। ব্লকের মতে পশ্চিম ইউরোপে নবম বা দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে সামন্ততন্ত্রের উত্থান ঘটেছিল, অন্যদিকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের ঘটে দ্বিতীয় সামন্ত যুগে অর্থাৎ দ্বাদশ শতকের পরে, যার মূল ভিত্তি ম্যানরব্যবস্থা।
Nature of Feudalism
In the 9th and 10th centuries, when centralized governance in Europe collapsed, land-dependent elites and government officials developed an alternative political, economic, and social system as a substitute for monarchy. This system is known as feudalism. The feudal system emerged out of the disintegration of unified political systems and ended with the re-establishment of strong central authority. This system persisted in Europe for approximately 500 years, from around 800 to 1300 CE.The word "feud" refers to land, indicating that this system was undoubtedly centered around land ownership. Feudalism was essentially a governmental system in which the central administration was absent, and political power was decentralized among landowners. In ancient Rome, wealthy elites assumed the responsibility of protecting their dependents, who, in return, provided services and unwavering loyalty. This relationship between lords and vassals formed the foundation of the feudal system. Historian Marc Bloch explained that feudalism arose from the combined processes of vassalage (a contractual relationship between lords and vassals) and fief (land grants) and was formalized through investiture (ceremonial granting of land and rights). Historian Ganshof, in his book Feudalism, defined the system as one that revolved around the relationship between lords and vassals in medieval Europe.
Feudalism was a closed system of production primarily based on agriculture. After the fall of the Western Roman Empire, barbarian tribes like the Goths, Vandals, and Franks took control of regions in Western Europe and claimed land ownership, much like monarchs. They distributed lands among their kin. Initially personal, these land distributions later became hereditary. Those who received land were obligated to provide military support and taxes to their king or leader. These land units were known as fiefs, and their holders were referred to as feudals or lords. Hence, this production system became known as feudalism. The feudal society was structured into three primary classes: the king at the top of the pyramid, a large number of feudal lords at the second level, and peasants, serfs, barons, and knights at the base.
Even though feudalism undermined monarchy, the king remained at the top of the feudal hierarchy. The king was the ultimate authority over land, governance, and justice, delegating these rights to landowners, who, in turn, passed them down to vassals. In this system, apart from the king, everyone was essentially a vassal. A vassal would formally pledge allegiance and loyalty to their lord. Breaking such oaths was considered a moral offense. Oath-taking ceremonies involved religious scriptures and the church as witnesses. If a vassal broke their oath, the lord could take military action against them. A vassal could have multiple lords but would designate one as their primary lord.
The relationship between a lord and a vassal was contractual. The lord would protect the vassal’s fief (land), offering assistance in warfare, governance, and justice. In return, the vassal would provide taxes, services, and military aid. If one party failed to uphold their part of the agreement, the other was no longer obligated to their duties. When a lord visited a vassal’s fief, the vassal was responsible for their food and lodging. If a vassal disobeyed the lord's orders, the lord could mobilize other vassals to suppress the rebellious one. The payments made by the vassal to the lord were considered grants rather than taxes. However, in special circumstances, the king could demand money. Additionally, vassals had to pay inheritance taxes or relief. This mutual agreement was termed vassalage. Historian Marc Bloch stated that feudalism was a political-military system created through the joint processes of vassalage and fief.
The feudal system was closely linked to the manorial system. The manorial system was a socio-economic and political structure where the feudal lord exercised various rights over the serfs or peasants living on his manor. These included economic, judicial, and administrative rights. In return, serfs were provided protection from external threats and allowed to live and work on the manor’s land. Marc Bloch noted that the manorial system was not part of feudalism but served as its economic foundation.
Feudalism in Europe lacked uniformity in nature. The regional variations across Europe have been a subject of historical debate. Marc Bloch argued that true feudalism existed only within the former Carolingian Empire, encompassing modern-day France, western Germany, Italy, and central-western Europe. Elsewhere, feudal society took precedence. In England, feudalism emerged only after the Norman Conquest. In other regions, historical studies have focused more on feudal societies than the strict structure of feudalism, as the core elements of feudalism—fief and vassalage—were not as significant outside of France.
The regional diversity of feudalism stemmed from the varying contexts in which feudal structures developed across different regions and time periods. According to Bloch, feudalism arose in Western Europe between the 9th and 12th centuries. In contrast, Central and Eastern Europe experienced a second feudal age after the 12th century, characterized by the manorial system as its foundation.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন