সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনায় সংগ্রহশালার ভূমিকা | Role Museum in Cultural Heritage Management

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনায় সংগ্রহশালার ভূমিকা

সংগ্রহশালা বা মিউজিয়াম ছিল এক সময়ে কেবল মজুদ কক্ষ। তখন বিভিন্ন শিল্পজাত বস্তু সংগ্রহ করে তা মিউজিয়ামে মজুদ করা হত। পরবর্তীকালে সেগুলি সংরক্ষণ করার কথা ভাবা হয় এবং বর্তমানে সেগুলির সর্বজনীন প্রদর্শন মিউজিয়ামের অন্যতম প্রধান দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। সুতরাং প্রথম থেকেই মিউজিয়ামের কাজ ছিল দেশ বা জাতির সাংস্কৃতিক সম্পদ গচ্ছিত রাখা। তখন ঐতিহ্যবাহী সম্পদ বলতে কেবল সাংস্কৃতিক সম্পদকেই বোঝা হত। নদী, সমুদ্র, পাহাড় ইত্যাদিকে তখনো ঐতিহ্য হিসাবে গন্য করা হয় নি।

ঐতিহ্য দুই প্রকার: প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলতে প্রাচীন স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, প্রত্নতাত্বিক ধ্বংসাবশেষ, মুদ্রা, লিপি, লোককথা, লোক নৃত্য, ভাষা, লিপি, প্রথা পদ্ধতি ইত্যাদি। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আবার দুই প্রকার মূর্ত ঐতিহ্য এবং বিমূর্ত ঐতিহ্য। মূর্ত ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে বস্তুগত ঐতিহ্য, যেমন- স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি। আর বিমূর্ত ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে ভাষা, লিপি ইত্যাদি। এগুলোকে ছুঁয়ে অনুভব করা যায় না। তাই এগুলিকে অস্পর্শক ঐতিহ্যও বলে।

মূর্ত ও বিমূর্ত দুই প্রকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে মিউজিয়ামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মিউজিয়াম প্রথমে ঐতিহ্যশালী বস্তুগুলিকে চিহ্নিত করে। তারপর সেগুলি সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করে এবং পরিশেষে সুষ্ঠু উপায়ে সাধারণের জন্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে মানুষকে তার ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। মূর্ত ঐতিহ্য গুলির মধ্যে যেগুলি স্থাবর সেগুলিকে মিউজিয়ামে নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। যেমন, তাজমহলকে তো আর মিউজিয়ামে রাখা যায় না। এক্ষেত্রে স্থাবর ঐতিহ্যকে তার নিজস্ব জায়গায় সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে অস্থাবর ঐতিহ্য সংরক্ষণে মিউজিয়ামের ব্যাপক অবদান। একথা ঠিক যে ঐতিহ্যের বস্তুকে তার নিজস্ব জায়গায় রেখে তা অনেক বেশি আন্তরিক হয় এবং তার নিজস্বতা বজায় থাকে। তবে সংরক্ষণ ভাবনায় তাকে খোলা আকাশের নিচে রোদে, জলে রাখা যায় না। তাই প্রয়োজন সংগ্রহশালার।

বিমূর্ত ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা মিউজিয়ামের কাছে একটি চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। কোনো গোষ্ঠীর নিজস্ব লোককথা, লোকগান, লোকনৃত্য, ভাষা,খাদ্যাভ্যাস, বাসস্থান, পোশাক পরিচ্ছদ ওই গোষ্ঠীর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় পশ্চিম বঙ্গের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে বাউল গান, ছৌ নাচ ইত্যাদি। এগুলির অনেকগুলি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন ছৌ নাচের শিল্পী আর তেমন পাওয়া যায় না। নবীন প্রজন্ম এসবে আগ্রহ হারাচ্ছে। তাই মিউজিয়াম বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি অবলম্বন করে।
১. টেপ রেকর্ডারের মাধ্যমে লোকগান, লোককথা ও ভাষা সংগ্রহ করে রাখে।
২. ভিডিও রেকর্ডারের মাধ্যমে লোকনৃত্য, যাত্রা, নাটক, বা বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সংগ্রহ করে রাখে।
৩. বিমূর্ত ঐতিহ্যের বিভিন্ন দুর্লভ মুহূর্ত আলোকচিত্রের মাধ্যমে ধরে রাখা হয়।
৪. লোকনৃত্য, গান, যাত্রা প্রভৃতির সাথে জড়িত বিভিন্ন পার্থিব বস্তু, যেমন ছৌ নাচের মুখোশ, পোষাক, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
৫. বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হল প্রশিক্ষণ। পুরানো দক্ষ শিল্পী কে দিয়ে নবীন প্রজন্মের শিল্পীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, যাতে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির জীবন্ত সংরক্ষণ সম্ভব হয়।

বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে মিউজিয়াম গুলি একটি অভিনব পদ্ধতি চালু করেছে। নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহে অথবা খোলা মঞ্চে লোকচর্চা গুলি দক্ষ শিল্পীকে দিয়ে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এতে একদিকে যেমন শিল্পীদের আয়ের উৎস হয় তেমনি স্থানীয় ঐতিহ্য গুলি বাইরের পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা যায়। কর্নাটকের জনপদ লোক মিউজিয়াম সারা বছর ধরে বিভিন্ন উৎসব এবং তার সঙ্গে জড়িত লোকগান, লোকনৃত্য ও রীতিনীতি পালন করে।

The Role of Museums in Cultural Heritage Management

At one time, museums were merely storage rooms where various artifacts were collected and stored. Later, the idea of preserving these items emerged, and today, public exhibition has become one of the primary responsibilities of museums. Therefore, from the beginning, the role of museums has been to preserve the cultural assets of a country and nation. Back then, the term "heritage" referred only to cultural assets. Natural assets like rivers, seas, and mountains were not yet considered part of heritage.

Heritage can be divided into two types: natural and cultural. Cultural heritage includes ancient architecture, sculptures, paintings, archaeological remains, coins, scripts, folklore, folk dances, languages, scripts, customs, and traditions. Cultural heritage can further be divided into tangible and intangible heritage. Tangible heritage includes material assets like architecture and sculptures, whereas intangible heritage encompasses languages, scripts, and other non-physical elements.

The role of museums in preserving both tangible and intangible cultural heritage is undeniable. Museums first identify heritage objects, then collect, document, and finally arrange for their proper exhibition to acquaint people with their heritage. Tangible heritage items that are immovable, like the Taj Mahal, cannot be stored in museums. In such cases, arrangements are made to preserve them in their original locations. However, museums play a significant role in preserving movable heritage. Although heritage items are more authentic when kept in their original places, they cannot be left exposed to the elements. This necessitates the existence of museums.

Preserving intangible heritage presents a significant challenge for museums. The unique folklore, folk songs, folk dances, languages, dietary habits, housing, and clothing of a community constitute its intangible cultural heritage. For example, West Bengal's intangible cultural heritage includes Baul songs Chhau dance etc. Many of these are gradually disappearing, as there are fewer Chhau dancers, and the younger generation is losing interest in such traditions. To preserve intangible cultural heritage, museums adopt the following methods:

1. Collecting folk songs, stories, and languages using tape recorders.

2. Recording folk dances, plays, and various religious and cultural events with video recorders.

3. Capturing rare moments of intangible heritage through photography.

4. Preserving physical objects related to folk dances and songs, such as Chhau dance masks, costumes, and musical instruments.

5. The most effective method for preserving intangible cultural heritage is through training. Arranging for old, skilled artists to train the new generation ensures the living preservation of traditional culture.

Museums have also introduced innovative methods for exhibiting intangible cultural heritage. They arrange for skilled artists to perform folk traditions in their own auditoriums or open stages. This not only provides artists with a source of income but also showcases local heritage to outside tourists. The Janapada Loka Museum in Karnataka, for instance, celebrates various festivals year-round and hosts related folk songs, dances, and customs.


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ