সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পশ্চিম এশিয়ায় নব্যপ্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির বিস্তার | Neolithic Culture in West Asia

পশ্চিম এশিয়ায় নব্যপ্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির বিস্তার 

নব্য প্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করা যায় মানুষের খাদ্য উৎপাদক হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে। কোথায় প্রথম মানুষ কৃষিকাজ করতে শুরু করেছিল তা নিয়ে ১৯৪০ এর দশক পর্যন্ত পণ্ডিত মহলে একটি ভ্রান্ত ধারণা ছিল। অনুমান করা হত যে প্রাচীন নদীমাতৃক সভ্যতা গুলি যেখানে অবস্থিত ছিল (যেমন মিশরীয়, মেসোপটেমিয়া ইত্যাদি) সেখানেই প্রথম চাষাবাদ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫০ এর দশকে এই ধারনার আপাদমস্তক বদল ঘটে উইলিয়ার্ড লিবির Radio Carbon Dating আবিষ্কারের ফলে। Radio Carbon Dating প্রযুক্তি প্রয়োগ করে আজ এটা প্রমানিত যে চাষাবাদ কোনো নদী তীরবর্তী আদ্র এলাকায় সূচনা হয় নি, হয়েছিল পাহাড়ের পাদদেশে বা তৃনভূমি এলাকায়। 

পশ্চিম এশিয়ায় চাষাবাদের সূচনা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১০,৫০০ বছর আগে। যে সমস্ত প্রত্নক্ষেত্রগুলি আবিস্কৃত হয়েছে সেগুলির অবস্থান মোটামুটি ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের মরুসাগর উপকূল বরাবর এলাকা, জর্ডন উপত্যকা, সিরিয়া, ইরাক, জাগ্রোস পর্বতমালা এবং উত্তর-পশ্চিম ইরানে। পশ্চিমে প্রায় তুরস্ক পর্যন্ত এলাকায় চাষাবাদের সূচনা হয়েছিল। তবে সবথকে প্রাচীনতম প্রত্নক্ষেত্রগুলি হল প্যালেস্টাইনের জেরিকো এবং উত্তর ইরাকের জারমো ও জাওয়াই সেমি শনিদার।

মরু সাগরের কাছে অবস্থিত জেরিকো প্রত্নক্ষেত্রে চাষাবাদের প্রাচীনতম প্রমান পাওয়া গেছে। এর প্রাচীনত্ব আজ থেকে প্রায় ১০,৫০০ বছর পুরানো। এখানকার মানুষ কৃষি নির্ভর সমাজের অচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে স্থায়ী বসবাসের জন্য কুড়ে ঘর তৈরি করত। প্রথম দিকে গোলাকৃতি বাড়ি বানাতো, কিন্তু পরবর্তীকালে আয়তাকার রূপ নেয়। জেরিকোর নব্য প্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতিকে মোটামুটি দুটি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে- Pre Pottery neolithic এবং Post-pottery Neolithic. Pre Pottery neolithic এর প্রথম দুটি স্তরে মানুষ মাটির পাত্রের পরিবর্তে চুনাপাথরের তৈরি পাত্র ব্যবহার করত। বাড়িগুলিতে পাথরের তৈরি পিট থাকত, যেগুলি সম্ভবত ফসল সংরক্ষনের জন্য কাজে আসত। এই পর্বের সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষক দিকটি হল এর বিরাট দেওয়াল, যা নির্মিত হয়েছিল পাথর দিয়ে।  মৃৎপাত্র প্রচলিত হওয়ার পর সমাজে একাধিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছিল। মাটির পাত্রকে  নিয়ন্ত্রিত আগুনে পুড়িয়ে তাকে টেকসই করা হত। আগুনকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে ব্যবহার করার বিদ্যা তারা আয়ত্ত করেছিল বলে সম্ভবত পরবর্তীকালে ধাতু ব্যবহারে সুবিধা হয়েছিল। 

জেরিকোর পার্শ্ববর্তী সিরিয়ার আবু হুরেরা এবং জর্ডানের আইন গজলে কৃষিকাজ শুরু হওয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে। জেরিকো সহ এই তিন প্রত্নক্ষেত্রে গম, বার্লি প্রভৃতি দানা শস্য চাষের সন্ধান পাওয়া গেছে। তারা ভেড়া ও ছাগল প্রতিপালন করত। এই প্রত্যক্ষেত্রগুলি থেকে প্রচুর পরিমানে কৃষি যন্ত্রপাতি, বিশেষ করে কাস্তে ও হামন দিস্তা পাওয়া গেছে। তখন বল্লমের ব্যবহার ছিল, যা প্রমান করে যে নব্য প্রস্তর যুগীয় অর্থনীতিতে শিকার একেবারে ব্রাত্য ছিল না। 

১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট ব্রেডউড জ্যাগ্রস পর্বতের পাদদেশে উত্তর ইরাকের জারমো এলাকায় একটি নব্য প্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির সন্ধান পান। জারমো'র আবিষ্কার কৃষিকাজের সূচনা সংক্রান্ত ধারণার বৈপ্লবিক পরিবর্তনটি ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে এই প্রত্নক্ষেত্রের প্রাচীনত্ব আজ থেকে প্রায় ৭০০০ বছর পুরানো। পার্শবর্তী আরও একটি নব্য প্রস্তর যুগীয় প্রত্যক্ষেত্র হল আলি কোষ (আজ থেকে প্রায় ১০,০০০ বছর পুরানো)। আজ থেকে ১১,০০০ বছর আগের জাওয়াই সেমি শনিদার প্রত্নক্ষেত্রে পশুপালন ও স্থায়ী বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে। আলি কোষ এবং জারমো'তে ক্রমশ চাষাবাদ এবং স্থায়ী বসতি গড়ে উঠেছিল। এখানেও আয়তাকার বাড়ি, ফসল সংরক্ষণের জন্য পিট, কৃষি উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন প্রকার প্রস্তরায়ুধ (যেমন কাস্তে ও হামন দিস্তা) ব্যবহারের নজির পাওয়া গেছে। গবেষণার ফলে জানা গেছে যে, জার্মো এলাকায় বসবাসকারী নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ তাদের জীবিকার মাত্র ২০% খাদ্য সংগ্রহের মাধ্যমে অর্জন করত। এর থেকে এই সমাজ কতটা কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়।

আনাতোলিয়ায় নিয়মিত কৃষিকাজের সূচনা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৯,৫০০ বছর আগে। কায়োনু এবং হ্যাকিলারের প্রত্যক্ষেত্রগুলি এর প্রমাণ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নব্য প্রস্তরযোগ্য প্রত্নক্ষেত্রটি হল ক্যাটাল হুউইক (৮০০০ বছর পুরানো)। ৩২ একর এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই প্রত্নক্ষেত্রে বহু সংখ্যক রোদে পোড়া ইটের বাড়ি এবং সমাধির অবশেষ পাওয়া গেছে। এই বসতি কার্যত একটি নগরে পরিণত হয়েছিল। এরা বিবিধ দ্রব্যের বাণিজ্যও করত।

আজ থেকে প্রায় ৭০০০ থেকে ৬০০০ বছর আগে প্রায় সর্বত্রই কৃষিকাজের সূচনা হয়ে গেছিল। পশ্চিম এশিয়ার গন্ডি পেরিয়ে কৃষি প্রযুক্তি দক্ষিণ ইউরোপে এবং উত্তর আফ্রিকায় প্রসারিত হল। আজ থেকে ৬৫০০ বছর আগে নিল নদের উপত্যকায় ফাইয়ুম এবং মেরিমদে কৃষিকাজের সূচনা হল। 

Neolithic Culture in West Asia


The Neolithic culture can be identified through the transition from hunting-gathering to food production. Until the 1940s, there was a widespread misconception among scholars regarding the origins of agriculture. It was assumed that agriculture first began in the ancient riverine civilizations, such as those in Egypt and Mesopotamia. However, in the 1950s, this notion was completely overturned by Willard Libby's invention of Radio Carbon Dating. Through this technology, it has been proven that agriculture did not begin in riverine, humid areas but rather in foothill regions or grasslands.

Agriculture in Western Asia began approximately 10,500 years ago. The archaeological sites discovered are located along the Dead Sea coast in Israel and Palestine, the Jordan Valley, Syria, Iraq, the Zagros Mountains, and northwestern Iran. Agriculture began in areas as far west as Turkey. However, the oldest archaeological sites include Jericho in Palestine, and Jarmo and Jawi Chemi Shanidar in Northern Iraq.

The Jericho archaeological site near the Dead Sea provides the earliest evidence of agriculture, dating back about 10,500 years. The people of this region built huts for permanent settlement as an essential part of their agricultural society. Initially, they built round houses, which later evolved into rectangular shapes. The Neolithic culture of Jericho can be roughly divided into two phases: Pre-Pottery Neolithic and Post-Pottery Neolithic. In the first two levels of the Pre-Pottery Neolithic phase, people used limestone vessels instead of clay pots. The houses contained stone pits, likely used for storing crops. The most striking feature of this period is the massive defensive wall constructed with stones. After pottery became widespread, several technological advancements were observed. Clay pots were baked in controlled fire to make them durable. Their mastery of controlled fire likely facilitated later metal use.

Nearby sites in Syria, such as Abu Hureyra, and in Jordan, like Ain Ghazal, also provide evidence of the beginning of agriculture. Wheat and barley cultivation, as well as sheep and goat rearing, have been discovered in these sites, including Jericho. Numerous agricultural tools, particularly sickles and grinding tools, have been found. The presence of spears indicates that hunting was not entirely abandoned in the Neolithic economy.

In 1940, Robert Braidwood discovered a Neolithic culture in Jarmo, located at the foothills of the Zagros Mountains in Northern Iraq. The discovery of Jarmo significantly altered the understanding of the origins of agriculture. Archaeological research has proven that the Jarmo site dates back around 7,000 years. Another nearby Neolithic site is Ali Kosh, dating back approximately 10,000 years. The Jawi Chemi Shanidar site, dating back 11,000 years, provides evidence of animal husbandry and permanent settlement. Agriculture and permanent settlements gradually developed in Ali Kosh and Jarmo. Rectangular houses, pits for crop storage, and various types of stone tools, such as sickles and mortars, have been found. Research suggests that the Neolithic people of the Jarmo region obtained only 20% of their food through foraging, indicating their heavy reliance on agriculture.

Regular agriculture began in Anatolia around 9,500 years ago, as evidenced by the sites of Cayonu and Hacilar. However, the most important Neolithic site is Çatalhöyük, dating back 8,000 years. Spread across 32 acres, this site contains numerous sun-dried brick houses and burial remains. This settlement effectively became a city, engaging in the trade of various goods.

By about 7,000 to 6,000 years ago, agriculture had begun almost everywhere. Beyond Western Asia, agricultural technology spread to Southern Europe and North Africa. Around 6,500 years ago, agriculture began in the Fayum and Merimde regions of the Nile Valley.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ