সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভারতে ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইনসমূহ | Heritage Protection and Conservation Act in India

ভারতে ঐতিহ্য সংরক্ষণ আইন

কোন দেশের ঐতিহ্যই সেই রাষ্ট্রের পরিচয়। ঐতিহ্য সামাজিক তথা জাতির সম্পদ। প্রাকৃতিক কিংবা সংস্কৃতিক, মূর্ত কি বিমূর্ত সকল প্রকার ঐতিহ্যই সংরক্ষণ প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণ এবং মনুষ্য সৃষ্ট ক্রিয়া-কলাপ এর ফলে ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্য গুলি বিপদের সম্মুখীন হয়েছে এবং কিছু কিছু ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়েছে। তাই কোম্পানির আমল থেকে শুরু করি ভারতে ঐতিহ্য সংরক্ষণের আইনি প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছিল এবং স্বাধীনতার পর থেকে সেই প্রচেষ্টা আরো বেশী দৃঢ় হয়েছে।

ভারতে ঐতিহ্য সংরক্ষণ একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। সংবিধানের ৫১ক অনুচ্ছেদে নির্দেশমূলক নীতিতে আমাদের দেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কে রক্ষা করার ক্ষেত্রে নাগরিকদের দায়িত্বকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সাথে জাতির কাছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভবন বা সৌধ এবং বস্তুকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকাও উল্লেখ করা হয়েছে।

ব্রিটিশ যুগে সংরক্ষণ আইন 

ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভবন গুলি সংরক্ষণের আইনগত প্রয়াস প্রথম লক্ষ্য করা যায় কোম্পানি শাসনকালে। বাংলায় ১৮১০ সালের ১৯ নম্বর রেগুলেশনে, মাদ্রাজে ১৮১৭ সালে ৭ নম্বর রেগুলেশনে এবং ১৮৬৩ সালের ২০ আইনে এ বিষয়ে প্রথম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১৮৬১ সালে Archeological Survey of India প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর ১৮৭৮ সালে The Indian Treasure Trove Act জারি করা হয়। এটিই ছিল প্রথম সর্বভারতীয় ঐতিহ্য সংগ্রহ সংক্রান্ত আইন। আইনে বলা হয়েছিল, ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদকে স্থানীয় জেলা কালেক্টর এর মধ্যস্থতার মাধ্যমে, প্রয়োজনে দাবিদারকে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে সরকার অধিকার ও সংরক্ষণ করবে। তবে সংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের কোন উল্লেখ এই আইনে ছিল না। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জনের শাসন কালে The Ancient Monuments Preservation Act জারি করে ঐতিহাসিক পুর্বিক বা নান্দনিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন ভবন বা সৌধগুলিকে রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলা হয়েছিল।

স্বাধীনত্তোর ভারতের ঐতিহ্য সংরক্ষণ আইন

স্বাধীন ভারতের প্রথম ঐতিহ্য সংক্রান্ত আইন জারি হয় ১৯৪৭ সালে। এই আইন হল Antiquities (Export Control) Act, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল, ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পুরাবস্তুগুলি যাতে দেশের বাইরে কেউ পাচার করতে না পারে। এরপর ১৯৭২ সালে এই আইনটিকে বাতিল করে একই লক্ষ্যে The Antiquities and Art Treasure Act (AATA) জারি করা হয়।

স্বাধীনতার কালে ১৯৫০ এর দশকে ঐতিহ্য সংরক্ষণ বিষয়ক দুটি আইন সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ।  প্রথমটি হল The Ancient Monuments and Archeological Sites and Remains Act, 1951. এই আইনের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্তরের প্রত্নস্থল সৌধ এবং কেন্দ্রগুলোকে চিহ্নিত করে তাকে রক্ষণাবেক্ষণে শপথ নেয়া হয়। এর পর এই আইনটিকে আরো সুস্পষ্ট ভাবে বলবত করার জন্য ১৯৫৮ সালে ওই একই নামে নতুন একটি আইন কার্যকর করা হয়। এই আইনের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্তরে গুরুত্বপূর্ণ সৌধ, প্রত্নস্থল ও প্রত্নাবশেষকে চিহ্নিত বা তালিকাভুক্ত করা, প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননকে স্বীকৃতি দেওয়া, ভাস্কর্য এবং অতীতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খোদাই করা কাজকে রক্ষা করার কথা বলা হয়। AMASR কে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে একটি আইন জারি করে সংরক্ষিত সৌধ বা বস্তুকে আঘাত করা বা কোনো হানি ঘটানোকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করা হয় এবং এর জন্য সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা জরিমানা ধার্য করার কথা বলা হয়।

২০১০ সালে AMASR আইনের কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয় এবং National Monument Authority গঠন করা হয়। এই সংশোধনের মাধ্যমে সৌধগুলির চারপাশে একটি নিয়ন্ত্রিত এবং একটি নিষিদ্ধ বলয় তৈরি করার কথা ঘোষিত হয় (অনুচ্ছেদ ২০)। এই সংশোধনীর মাধ্যমে NMA এর কার্যাবলী ও ক্ষমতাকে স্থির করা হয়। বলা হয় যে, ২০১০ সালের আগে স্বীকৃত ও তালিকাভুক্ত সুরক্ষিত জাতীয় সৌধগুলিকে পর্যায়ভূক্ত করার জন্য এবং তাকে সংরক্ষিত এলাকা রূপে গণ্য করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই সংস্থা সুপারিশ করবে এবং ২০১০ সালের পর এইরূপ সৌধগুলিকে চিহ্নিত করে তাকে সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। এই সংস্থা ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য গঠিত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাজের উপর নজর রাখবে এবং যে সমস্ত প্রকল্প ঐতিহাসিক সৌধ বা ভবনের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় প্রভাব ফেলবে বা ক্ষতি করবে সে ক্ষেত্রে উপযুক্ত সংশোধনীর জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবে।

Heritage Preservation Laws in India

The heritage of a country defines its identity. Heritage is a social and national asset, whether natural or cultural, tangible or intangible, and it needs preservation. Various natural causes and human activities have endangered and destroyed some of India's ancient heritage. Therefore, legal efforts to preserve heritage have been evident since the colonial era and have become stronger post-independence.

Constitutional Mandate for Heritage Preservation in India

Heritage preservation is a constitutional obligation in India. Article 51A of the Directive Principles of State Policy in the Indian Constitution reminds citizens of their duty to protect the country's diverse cultural heritage. It also emphasizes the role of the state in properly preserving historically significant places, buildings, and objects.

Preservation Laws during the British Era

The first legal efforts to preserve historically significant buildings can be traced back to the colonial period. In Bengal, Regulation No. 19 of 1810, in Madras Regulation No. 7 of 1817, and Act 20 of 1863, initially highlighted the importance of this issue. The Archaeological Survey of India (ASI) was established in 1861. Later, in 1878, the Indian Treasure Trove Act was introduced, which was the first nationwide law concerning heritage collection. This act stated that historically or archaeologically significant assets could be claimed and preserved by the government through the local district collector, compensating the claimant if necessary. However, this act did not mention the preservation of cultural heritage. In 1904, during Lord Curzon's administration, the Ancient Monuments Preservation Act was introduced to maintain ancient buildings or monuments of historical or aesthetic importance.

Post-Independence Heritage Preservation Laws in India

The first heritage-related law in independent India was issued in 1947. This law, the Antiquities (Export Control) Act, aimed to prevent the smuggling of historically significant antiquities out of the country. In 1972, this law was replaced by the Antiquities and Art Treasures Act (AATA) with the same objective.

Two significant heritage preservation laws were enacted in the 1950s. The first was the Ancient Monuments and Archaeological Sites and Remains Act of 1951, which identified and pledged to maintain national-level archaeological sites and monuments. To make this law more explicit, a new act with the same name was implemented in 1958. This act identified and listed nationally significant monuments, archaeological sites, and remains, recognized archaeological excavations, and aimed to protect sculptures and important historical carvings. To strengthen the AMASR, a law was enacted in 1959, declaring it a punishable offense to damage or harm any protected monument or object, with a maximum fine of 5000 rupees.

In 2010, amendments were made to the AMASR Act, and the National Monument Authority (NMA) was established. These amendments introduced the creation of regulated and prohibited zones around monuments (Article 20). The NMA's functions and powers were defined, stating that the organization would recommend the central government classify and consider the preservation of monuments recognized and listed before 2010 and identify and recommend the preservation of such monuments post-2010. This organization monitors the work of appropriate authorities formed for heritage preservation and suggests suitable modifications to the government for any projects that may impact or damage the preserved areas of historical monuments or buildings.


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ