মুঘলদের পতন
১৫২৬ খ্রিঃ পানিপথের যুদ্ধে বাবরের জয়লাভের মাধ্যমে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু হয় এবং মহান আকবরের শাসনকালে মুঘল সাম্রাজ্য তার ভিত মজবুত করতে সক্ষম হয়। সপ্তদশ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শহর দিল্লি সমগ্র পূর্ব গোলার্ধের ক্ষমতার অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হত। কিন্তু ১৭০৭ খ্রিঃ মহান ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এই সাম্রাজ্যের ক্রমিক অবক্ষয়ের সূচনা হয় এবং আগামী ৫০ বছরের মধ্যে এর পড়ন্ত অবস্থার লক্ষনগুলি সুস্পষ্ট হয়ে যায়। উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে সাম্রাজ্যের সামরিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। মারাঠারা সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে লুঠপাঠ চালাতে থাকে। পরপর দুটি বিদেশি অক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থতা, পারস্যের নাদির শাহের আক্রমণ (১৭৩৮-৩৯) এবং আহম্মদ শাহ আবদালির নেতৃত্ব আফগান আক্রমণ (১৭৫৬-৫৭) মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতাপ ও মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে।
মুঘলদের পতনের কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে একসময় ব্যক্তিবিশেষের ভূমিকাকে বড় করে দেখা হত। মনে করা হত দুর্বল উত্তরাধিকারী, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত নীতি ইত্যাদি কারনে সাম্রাজ্যের অবনতি ঘটে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস চর্চায় সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে মুঘলদের পতন নিহিত ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
আচার্য যদুনাথ সরকার মুঘলদের পতনের কারন আলোচনা প্রসঙ্গে দুর্বল উত্তরাধিকারী এবং অযোগ্য সেনাপতিদের ভুমিকার কথা বলেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক টি. জি. পি. স্পিয়ার মনে করেন, ১৮ শতকে অন্তত যোগ্য মুঘল নেতার অভাব ছিল না। এই সময়েই সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়, নিজাম-উল-মুল্ক, আবদুস সামাদ খান, জাকারিয়া খান, সাদাৎ খান, সফদর জং, মুর্শিদকুলি খান কিংবা সোয়াই জয়সিং এর মত নেতৃত্ব ছিলেন। কিন্তু এদের কারোর সাম্রাজ্যের দুর্দিনে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার সদিচ্ছা ছিল না; বরং তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির প্রচেষ্টায় সাম্রাজ্যের ক্ষতি হয়েছিল।
মুঘল সাম্রাজ্য মুলত সামরিক রাষ্ট্র। মুঘল সামরিক ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল মনসবদারি ব্যবস্থা। মনসবদাররা সাম্রাজ্যের জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত রাখতেন এবং এর পরিবর্তে সম্রাটের কাছ থেকে তাঁরা বেতন (জাট দ্বারা নির্ধারিত) এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ (সওয়ার দ্বারা নির্ধারিত) পেতেন। এরাই ছিলেন সাম্রাজ্যের অভিজাত। আকবর ছিলেন মনসবদারি ব্যবস্থার প্রবর্তক। মনসবদারদের একটা বড় অংশ নগদ বেতনের পরিবর্তে জমির জায়গির পেতেন। এদের জাগিরদার বলা হত। মুঘলদের সামরিক সাফল্য নির্ভর করত সম্রাটের নেতৃত্ব এবং সম্রাট ও অভিজাতদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক তথা সম্রাটের প্রতি তাঁদের প্রশ্নাতীত আনুগত্য এবং সাম্রাজ্যের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতার উপর। ১৮ শতকে সাম্রাজ্যে এমন পরিস্থিতির আবির্ভাব ঘটে যে, এই আনুগত্য ও দায়বদ্ধতায় ঘাটতি দেখা দেয়।
মুঘল অভিজাত সম্প্রদায় তিনিটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলঃ ইরানি, তুরানি ও হিন্দুস্তানি। ইরানিরা ছিলেন ইরান, আফগানিস্তান ও ইরাকের ফার্সি-ভাষী অঞ্চল থেকে আগত; তুরানিরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কিভাষী অঞ্চল থেকে আগত। আর হিন্দুস্তানিরা ছিলেন আফগান, দেশীয় মুসলমান, রাজপুত ও মারাঠা অভিজাত। ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির ফলে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে দক্ষিনী মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র দেখিয়েছেন ১৮ শতকে মনসবদারদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এদিকে পাইবাকি (বন্টনযোগ্য) জমির সংখ্যা বৃদ্ধি পায় নি, বরং কমে আসে। নতুন করে যেসব জাগির দেওয়া হত সেগুলিতে, বিশেষ করে দাক্ষিনাত্যে জমা'র (মূল্যায়িত রাজস্ব) তুলনায় হাসিল'এর (প্রকৃত আদায়) বিস্তর ব্যবধান থাকত। ফলে মনসবদারদের প্রকৃত আয় কমে যায়। এর উপর ইউরোপীয় বিলাসদ্রব্য বাজারে ইতিমধ্যে ঢুকে পরেছিল। এর ফলে অভিজাতদের জীবনযাত্রার মান ইতিমধ্যে বেড়েই গেছিল। এর ফলে ভালো জমি পাওয়া এমনকি জমি পাওয়া তাঁদের কাছে অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। এই নিরাপত্তাহীনতা অভিজাতদের মধ্যে দলাদলিকে তীব্র করে তোলে।
ভালো আয়যুক্ত জমি পাওয়ার জন্য প্রত্যেকেই সম্রাটের নজর কাড়তে চেষ্টা করতে থাকেন। ১৭১২ খ্রিঃ বাহাদুর শাহের মৃত্যুর সময় জায়গিরদারি সমস্যা একটি সংকটের আকার ধারন করে এবং জাহান্দার শাহ এবং ফারুখশিয়রের সময় তা তীব্র আকার ধারন করে। তিনটি দল পরস্পর বিরোধী অবস্থান নেয়। ইরানি দলের নেতৃত্বে ছিলেন আসাদ খান ও তাঁর পুত্র জুলফিকার খান; তুরানি দলের নেতৃত্বে ছিলেন ফিরোজ জং ও তাঁর পুত্র চিন কুলিচ খান এবং হিন্দুস্তানি দলের নেতৃত্বে ছিলে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়, খান-ই-দৌরান এবং কিছু আফগান ও হিন্দু নেতা। যে দল যখন সিংহাসনের কাছাকছি থাকত সেই দল তখন সুবিধা পেত এবং অন্য দলগুলি বঞ্চিত হত। এই বঞ্চনাই সম্রাটের প্রতি আনুগত্য এবং সাম্রাজ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তাঁদের বিরত করেছিল।
১৭ শতকের শেষ দিকে এবং ১৮ শতকের শুরুর দিকে মুঘল রাষ্ট্র একাধিক কৃষক বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছিল। এই সব বিদ্রোহে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতেন মুঘল অভিজাতদের উপর ক্ষিপ্ত জমিদারেরা। বিদ্রোহগুলিকে ঐতিহাসিকগন নানা ভাবে ব্যখ্যা করেছেন। অনেকে ঔরঙ্গজেবের গোঁড়ামিপূর্ণ ধর্মনীতিকে দায়ি করেছেন। তবে এই ব্যখ্যা মানা যায় না, কারন ঔরঙ্গজেব তাঁর রাজত্বকালের শেষ দিকে যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। মুঘল রাষ্ট্রে কৃষি সংকট ও কৃষক বিদ্রোহগুলির একটি যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন অধ্যাপক ইরফান হাবিব। হাবিব দেখিয়েছেন মুঘল ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা টিকে ছিল একটি বোঝাপড়ার উপর। কৃষকের কাছে তাঁর ন্যূনতম গ্রাসাচ্ছাদন রেখে ভূমিরাজস্বের মাধ্যমে রাষ্ট্র উদ্বৃত্ত উৎপাদনকে যতটা সম্ভব তুলে নেওয়ার চেষ্টা করত। কৃষকের গ্রাসাচ্ছাদনে টান না পড়লে বিদ্রোহ করত না। কৃষক ও রাষ্ট্রের মাঝখানে ছিল জমিদারেরা। বড় জমিদার বা পেশকশি জমিদাররা তাঁদের এলাকায় স্বশাসন ভোগ করতেন। তাঁদের জমিদারিকে 'ওয়াতন' স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। একেবারে নিচু তলায় থাকতেন মালগুজারি জমিদার। এঁরা রাজস্বমুক্ত জমির বিনিময়ে কৃষকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব নিতেন। এদের সাথে কৃষকদের জাতিগত, গোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় বন্ধন থাকত, যা ছিল তাঁদের ক্ষমতার অন্যতম উৎস। তাছাড়া অনেকের হাতে স্থানীয় নিরাপত্তার ভার থাকত। অকবর এদের অনুগত বন্ধু হিসাবে পেতে ছেয়েছিলেন। এদের সহযোগিতা ছাড়া দূরবর্তী স্থানে শাসন সম্ভব ছিল না।
ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ দিকে এবং তাঁর মৃত্যুর পর এই বোঝাপড়া ও আনুগত্যের সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। এর পশ্চাদে জায়গির সংকট আনেকাংশে দায়ি। জাগিরদাররা তাঁদের ঘাটতি মেটানোর জন্য যখন কৃষক উতপীড়ন শুরু করেন তখন কৃষকরা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়। আগের মুঘল সম্রাটরা তাঁদের শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে জাগিরদারদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন এবং প্রয়োজনে বদলি করতেন। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এই নজরদারি প্রথা পুরোপুরি উঠে যায়। অনেক প্রভাবশালী জাগিরদার প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের বদলি রুখে দিতে পারতেন। তাছাড়া জাগির ব্যবস্থায় ইজারা প্রথার সংযুক্তি কৃষকদের বোঝা অনেক বাড়িয়ে দেয়। এই প্রেক্ষাপটে কৃষকরা স্বজাতীয় স্থানীয় জমিদারদের নেতা হিসাবে পেয়ে যায়। জমিদারেরা রাষ্ট্রের প্রাপ্য মিটিয়ে দিতে সরাসরি অস্বীকার করে। দাক্ষিনাত্যে মুঘল বিরোধিতা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মারাঠা সর্দারেরা কৃষকদের এই অভিযোগগুলির সুযোগ নিতে থাকে। জাঠরাও বিদ্রোহ করে। এমনকি রাজপুত প্রধানরাও আর মুঘলদের অনুগত থাকে না।
জাগিরদারি সংকট ও কৃষক বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে মুঘল রাষ্ট্রে একাধিক আঞ্চলিক শক্তির বিকাশ ঘটে। বহু যোগ্য অভিজাত দরবারের দলীয় রাজনীতিতে বিরক্ত হয়ে সুবার দায়িত্ব নিয়ে দরবার ছাড়েন এবং ঐ সুবায় কার্যত স্বাধীন শাসনের সূচনা করেন। এভাবে হায়দ্রাবাদে নিজামি, অযোধ্যা ও বাংলায় নবাবি গড়ে ওঠে। আবার কৃষক বিদ্রোহ গুলিকে কেন্দ্র করে মুঘল বিরোধী আঞ্চলিক শাসন গড়ে ওঠে, যেমন- শিখ রাজ্য, মারাঠা স্বরাজ্য, জাঠ রাজ্য প্রভৃতি। আঞ্চলিক শক্তির বিকাশ মুঘল কেন্দ্রীয় শক্তির ভীত আলগা করে দেয়।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন 'সংশোধনবাদী' ঐতিহাসিকগন। তাঁদের বক্তব্য মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতিকে ব্যখ্যা করতে হবে সাম্রাজ্যের কেন্দ্র থেকে নয়, প্রান্ত থেকে। মুজফফর আলম বলেছেন, ১৮ শতকে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও বাণিজ্যিক মনোভাবের সুবিধা গ্রহন করে একদল ভুঁইফোড়ের আবির্ভাব হয়। এঁরা সাম্রাজ্যের সম্পদ একচেটিয়া ভাবে ভোগ করতে শুরু করে, পরম্পরাগত অভিজাতদের বাদ দিয়ে। এই সব ভুঁইফোড়েরাই ছিল আঞ্চলিক প্রভাবশালী ও শক্তিশালী ব্যাক্তিবর্গ। বিভিন্ন প্রদেশে এই সব লোকগুলি বিশিষ্ট হয়ে ওঠে এবং প্রশাসনিক কেন্দ্রীকরণকে এঁরা সাফল্যের সঙ্গে আটকে দিতে সক্ষম হয়। এইসব লোকেদের মধ্যে তারাও ছিলেন যারা জাগির বদলির নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় শাসক হয়ে বসতেন। এঁরা এলাকার রাজস্ব আদায় থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন। নিজেরা সেনাবাহিনী পুষতেন এবং মুঘল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ধৃষ্টতা দেখাতেন। প্রান্তীয় এলাকায় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ছাড়া এরকম সম্ভব ছিল না। মোরাদাবাদ, বেরিলি, অযোধ্যা, বারাণসী অনেক সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। বাংলা ছিল এই সময় সবথেকে সমৃদ্ধ। সুতরাং 'দারিদ্র্য ও সংকট' অপেক্ষা 'সঙ্গতিপূর্ণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি' স্থানীয় এলাকায় রাজনৈতিক অশান্তি বাধায়।
উপরের তিন ধরনের ইতিহাস চর্চার মাঝামাঝি কোনো একটি সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী শাসকদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থতা, কেন্দ্রীয় শক্তির ভাঙন বা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্রের প্রবল দাবি- কোনো ব্যখ্যাই অগ্রাহ্য নয়। তবে একথা বলা যায় যে মুঘল কেন্দ্রীয় শক্তির পতন হলে আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলিতে মুঘল ধারা বহুদিন বজায় ছিল। ইংরেজ কোম্পানির হাতে মুঘল শক্তির উৎপাটন পর্যন্ত সারা ভারতে মুঘলদের নাম, এমনকি ছায়াকে পর্যন্ত সম্মান করা হত।
Thank you sir.
উত্তরমুছুন