সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ঐতিহ্যের সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ | Heritage: Definition and Classification

ঐতিহ্যের সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ 

Heritage শব্দের উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ Hered বা Heres থেকে। এর অর্থ Heir বা উত্তরাধিকারী। Hered/Heres থেকে এসেছে ফরাসি শব্দ Heriter এবং এখান থেকে এসেছে ইংরেজি শব্দ Heritage। হেরিটেজ বা ঐতিহ্যের সংজ্ঞায় বলা যায়, ঐতিহ্য হল এমন কিছু যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মূল্যবান বলে বিবেচিত হয় এবং তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ইউনেস্কোর মতে, ঐতিহ্য হল আমাদের অতীতের উত্তরাধিকার, যেগুলি নিয়ে আমরা বর্তমানে বাঁচি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হস্তান্তর করি। আমাদের সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্য উভয়ই জীবন এবং অনুপ্রেরণার অপরিবর্তনীয় উৎস।

ঐতিহ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আমাদের উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত সমস্ত রীতিনীতি, স্মৃতিস্তম্ভ, বস্তু এবং সংস্কৃতি। ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (UMASS AMHERST Centre for Society and Heritage) মতে, ঐতিহ্য একটি সমসাময়িক কার্যক্রম যা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে এবং এটি দীর্ঘমেয়াদী শহুরে এবং আঞ্চলিক পরিকল্পনার অঙ্গ, রাজনৈতিক স্বীকৃতির জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম, আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপের মাধ্যম, নৈতিক প্রতিফলনের উপায় এবং স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি। এটি একদিকে স্থানীয় এবং নির্দিষ্ট, আবার অন্যদিকে বৈশ্বিক এবং যৌথ।

হেরিটেজ বা ঐতিহ্য প্রধানত দুই প্রকারঃ প্রাকৃতিক ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। 

প্রাকৃতিক ঐতিহ্যঃ প্রকৃতিগতভাবে সৃষ্ট ঐতিহ্যকে প্রাকৃতিক ঐতিহ্য বলে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যেমন-পাহাড়, নদী, বন, উপকূলীয় এলাকা ইত্যাদি; ভূতাত্ত্বিক গঠন, যেমন- পাহাড়, গুহা, জলপ্রপাত ইত্যাদি; কোন অভয়ারন্য বা জাতীয় উদ্দ্যান, জীববৈচিত্র্য প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদান হল প্রাকৃতিক ঐতিহ্য। অন্য কথায় বলা যায় প্রকৃতি প্রতিটি ভৌগলিক স্থানকে পৃথক পৃথক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রদান করেছে। এই নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বৈশিষ্ঠ্যগুলি বর্তমান প্রজন্মের কাছে অমূল্য সম্পদ হিসাবে বিবেচিত এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেগুলির সংরক্ষন ও সরবারহ করা দরকার। এই পৃথক বৈশিষ্ঠ্যসমূহই ওই এলাকার প্রাকৃতিক ঐতিহ্য। 

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যঃ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হল সেইসব ঐতিহ্যবাহী উপাদান যেগুলি মনুষ্যসৃষ্ট বা মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট অমূল্য সম্পদ, যেমন ঐতিহ্যবাহী স্থান, স্মৃতিস্তম্ভ, লোককাহিনী, ঐতিহ্যবাহী কার্যকলাপ এবং রীতি, ভাষা, এবং আরও অনেক কিছু। এগুলি মানুষকে বিশেষ সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যের সাথে সংযুক্ত হতে সহায়তা করে। শুধু তাই নয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মানুষকে একই ব্যাকগ্রাউন্ড এবং মানসিকতার লোকদের মানুষের সাথে সংযুক্ত করে।সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম এবং আমাদের উত্সের ইতিহাসকে বুঝতে সাহায্য করে এবং এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় একটি গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্ভুক্তির অনুভূতি এবং সংহতি বৃদ্ধি করতে পারে।সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিভিন্ন প্রথা, চর্চা, স্থান, শিল্পকর্ম, সৃজনশীল প্রকাশ এবং মূল্যবোধকে অন্তর্ভুক্ত করে। এটি একটি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠিত এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হস্তান্তরিত জীবনযাত্রার প্রতিফলন। 

মূর্ত ও বিমূর্ত ঐতিহ্যঃ ঐতিহ্য বর্ণনা করতে 'মূর্ত' এবং 'বিমূর্ত' এই দুটি শব্দ প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। মূর্ত ঐতিহ্য হল সেগুলি, যেগুলিকে আমরা চোখে দেখতে পারি বা স্পর্শ করতে পারি। মূর্ত ঐতিহ্য প্রাকৃতিক হতে পারে আবার সাংস্কৃতিক হতে পারে। প্রাকৃতিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, সমূদ্র, নদী, ঝর্না প্রভৃতি। আর মূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, সৌধ, মূর্তি প্রভৃতি। 

বিমূর্ত ঐতিহ্য বলতে যে ঐতিহ্যকে ছোঁয়া যায় না বা দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়, যেমন- গান, নাচ, চিত্রকলা, লোক ঐতিহ্য, সামাজিক প্রথা, মূল্যবোধ প্রভৃতি।

প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, মূর্ত বা বিমূর্ত যাই হোক না কেন ঐতিহ্য অমূল্য সম্পদ। ঐতিহ্য প্রকৃতি ও পূর্বপুরুষের দান। এগুলিকে সংরক্ষন করা দরকার এবং এর গুরু দায়িত্ব কেবল সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির নয়; জনগোষ্ঠীগুলি এবং পর্যটকগন এই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না।  

Heritage: Definition and Classification

The word "Heritage" originates from the Latin word "Hered" or "Heres," which means heir. From Hered/Heres comes the French word "Heriter," and from there comes the English word "Heritage." In the definition of heritage, it can be said that heritage is something considered valuable enough to be preserved for future generations and passed down to them. According to UNESCO, heritage is our legacy from the past, what we live with today, and what we pass on to future generations. Our cultural and natural heritage are both irreplaceable sources of life and inspiration.

Heritage includes all the traditions, monuments, objects, and culture we have inherited. According to the University of Massachusetts Amherst (UMASS AMHERST Centre for Society and Heritage), heritage is a contemporary activity with far-reaching effects and can be a part of long-term urban and regional planning, a platform for political recognition, a medium for intercultural dialogue, a means of ethical reflection, and the basis for local economic development. It is simultaneously local and particular, global and shared.

Heritage or tradition is primarily of two types: natural heritage and cultural heritage.

Natural heritage: Naturally created heritage is called natural heritage. Natural beauty, such as mountains, rivers, forests, coastal areas, etc.; geological formations, such as mountains, caves, waterfalls, etc.; any sanctuary or national park, biodiversity, etc., are natural elements that constitute natural heritage. In other words, nature has endowed each geographical location with distinct natural beauty. These specific natural features are considered invaluable assets to the present generation and need to be preserved and passed down to future generations. These distinct features are the natural heritage of that area.

Cultural heritage: Cultural heritage includes those traditional elements created by human activity or resulting from human actions, such as historical sites, monuments, folklore, traditional activities and traditions, language, and more. These elements help people connect with social values, religious beliefs, and traditions. Cultural heritage also helps people connect with others of similar backgrounds and mentalities. It enables us to understand previous generations and the history of our origins, fostering a sense of belonging and solidarity within a group. Cultural heritage includes various practices, customs, places, artifacts, creative expressions, and values. It reflects the way of life established by a community and passed down from generation to generation.

Tangible and intangible heritage: The terms 'tangible' and 'intangible' are often used to describe heritage. Tangible heritage includes things we can see or touch. Tangible heritage can be both natural and cultural. Natural tangible heritage includes mountains, valleys, seas, rivers, waterfalls, etc. Tangible cultural heritage includes temples, mosques, churches, monuments, statues, etc.

Intangible heritage refers to heritage that cannot be touched or seen but can be felt, such as songs, dances, paintings, folklore, social customs, values, and more.

Whether natural, cultural, tangible, or intangible, heritage is an invaluable asset. Heritage is a gift from nature and our ancestors. It needs to be preserved, and this responsibility does not solely lie with the government or governmental institutions; local communities and tourists also cannot avoid this responsibility.


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ