গনিকা ও বাবুর সম্পর্ক আলোচনা কর।
ব্রিটিশ কর্তৃক বাংলার শাসনভার গ্রহণের পর নতুন বাণিজ্যিক এবং প্রশাসনিক সম্পর্কের প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রাক উপনিবেশিক আর্থসামাজিক বিন্যাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলায় গণিকাবৃত্তিরও প্রবর্তন ঘটে।
উপনিবেশিক প্রশাসন ইউরোপীয় ও ভারতীয় সৈনিকদের জন্য ভারতীয় গণিকা নিযুক্ত করার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। সৈনিকদের স্থায়ী বাসস্থান সংশ্লিষ্ট বাজার ও নির্দিষ্ট স্থানে গণিকাদের প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারা "চাকলা" নামে পরিচিত ছিল। এই বেশ্যারা সাধারণত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল ১. গোরা চাকলা ২. লাল কুর্তা চাকলা এবং ৩. কালা চাকলা।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে কলকাতায় একশ্রেণীর ভু৺ইফোড় ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে, যারা ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ও প্রশাসনিক কর্তাদের দালালি করে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করেছিল। এদের উচ্চ স্তরে ছিলেন বেনিয়ান, দেওয়ান এবং সর্বনিম্নে মোশাহেব শ্রেণী। এরাই উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে কলকাতার গনিকাবৃত্তির প্রথম প্রজন্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সমসাময়িক হাস্যরসাত্মক নাটক, প্রেমপত্র ইত্যাদিতে এদের এবং এদের সঙ্গী গণিকাদের উল্লেখ আছে। এ যুগের প্রথম প্রজন্মের বাবুরা ছিলেন ধনী দেওয়ান, প্রশ্রয় প্রাপ্ত সন্তান যারা পিতার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থের দ্বারা মোসাহেবদের লম্পট সঙ্গী হয়ে গণিকা সৎসর্গ ও মদ্যপানে লিপ্ত থাকত।
কলকাতার প্রথম প্রজন্মের বাবুদের ব্যবহার জীবনের প্রমাণপত্র পাওয়া যায় বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন সাংবাদিক ও কবি ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনার মধ্যে। তাঁর নব বাবুবিলাস, দুতীবিলাস পুস্তকে গণিকাদের নিযুক্তকরন ও তাদের খরিদ্দারদের আপ্যায়নের ছলাকলার উপর বিশেষ আলোকপাত করা হয়েছে।
নব বাবুবিলাস এ কথিত আছে যে, বাবু নিজেকে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লম্পট বলে দাবি করেন। তিনি উপদেশ দিতেন যে চারটি "প" এর সাফল্য অর্জন করলে তিনি হবেন আর্ধবাবু। চারটি "প" ১. পাশা ২. পায়রা ৩. পরস্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক এবং ৪. পোশাক। এই চারটি 'প' এবং চারটি 'খ' যিনি সাফল্য অর্জন করবেন তিনি হবেন পরিপূর্ণ বাবু। চার 'খ' হলো ১. খুশি ২. খানকী ৩. খানা ৪. খয়রাৎ।
ভবানীচরণ কর্তৃক লিখিত নববিবিবিলাস থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার গণিকাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তুলে ধরা হয়। কেমন করে তাদের নিযুক্ত করা হয়, কিভাবে তাদের কর্মদক্ষ করে তোলা হয়, কিভাবে তারা সামাজিক মর্যাদার উচ্চস্তরে উন্নীত হয় এবং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভাগ্যের পতন ক্রমে পরের বাড়ির চাকরানীতে পরিণত হওয়া এবং পরিশেষে ভিক্ষাবৃত্তি তাদের একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়াত তা জানা যায়। পুরুষ খরিদ্দারদের আকর্ষণ করতে এবং ধনী খরিদ্দারদের অনুগ্রহ পেতে তাকে ছয়টি "ছ"অনুশীলন করতে হতো।
একজন গণিকা কেমন করে একজন স্ত্রী হবে বা তার ভাই কেমন করে শালা হবে? তাদের উপদেশ দেওয়া হয় যে আমাদের ভালোবাসা তাদের প্রতি যাদের প্রচুর অর্থ থাকে সেটাও বিশুদ্ধ ভালোবাসা নয়। সেটা মিথ্যা ভালোবাসা। তুমি এমন ভালোবাসার অভ্যাস করবে যার দ্বারা তুমি ভেসে না যাও। তুমি চেষ্টা করবে বাবুকে তোমার করতলগত করে রাখতে। আবেগমথিত সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়ার সতর্কতা থেকে মনে হয় যে ওই সময় গণিকাদের বিভিন্ন ইচ্ছা ও মনোভাব তাদের বাবুদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বৈবাহিক সম্পর্কের মত বন্ধনে আবদ্ধ হতে প্রাণোদিত করেছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন