সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাংলা থিয়েটারে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি

বাংলা থিয়েটারে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির অবদান আলোচনা কর।

প্রাচীনকাল থেকেই নাটকের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপযোগিতার দিক সমাজে স্বীকৃত হয়ে এসেছে। প্রথমত নাটক হল উন্নত সংস্কৃতির প্রচারক তথা চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম। দ্বিতীয়ত, জনশিক্ষা বা লোক শিক্ষার অন্যতম বাহন হল নাটক। ধরে নেওয়া হয় ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রই হল প্রাচীন ভারতের বা বৈদিক যুগে নাট্যচর্চার প্রধান অবলম্বন ও সূচনা। প্রাচীন ভারতে নাট্যশাস্ত্র পঞ্চম বেদ নামে সংস্কৃত সাহিত্যে পরিচিত হয়ে ওঠে। নাট্যবেত্তাগণ বলেন, প্রাচীন সংস্কৃত নাটকের ভিত্তি হল ঋকবেদের বাণী, সামবেদের গীতি, যজুর্বেদের অভিনয় এবং অথর্ববেদের অনুভূতি ও রস। এভাবেই গড়ে উঠেছিল সংলাপ সঙ্গীত ও অভিনয়ে সমৃদ্ধ এবং রসপূর্ণ। কালিদাস পূর্ব যুগের দুজন শ্রেষ্ঠ নাট্যকার রূপে মহাকবি ভাস এবং অশ্বঘোষের নাম পাওয়া যায় সেই হিসেবে ভারতবর্ষের নাট্যচর্চের কাল দুই সহস্র বছরের অধিক।

বাংলার নাট্যচর্চার জন্ম বলা চলে, দ্বাদশ শতকে জয়দেবের গীতগোবিন্দ, চতুর্দশ শতকে বডু চন্ডীদাস রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকেই। তবে ১৬ শতকের শ্রীচৈতন্যের নিত্যগীত সংলাপ প্রকৃতি থেকে যে কৃষ্ণ যাত্রা সূচনা তাকেই অনেকে বাংলার আদি নাট্য ক্রিয়ার উন্মেষ বলে মনে করেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর কয়েকজন প্রখ্যাত নট নাট্যকারের মধ্যে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি ছিলেন অন্যতম। তিনি একজন বাঙালি অভিনেতা, নাট্য লেখক এবং মঞ্চ ব্যক্তিত্ব। নাট্যজগতে তিনি "মুস্তোফী সাহেব" নামে পরিচিত ছিলেন। কলকাতার বাগবাজারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গিরিশ চন্দ্র ঘোষের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সহযোগী অভিনেতা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। মুস্তাফি গিরিশ ঘোষকে ১৮৭২ সালে জাতীয় থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছিলেন।

১৮৯৩ সালে পরের অর্ধেন্দুশেখর নতুন করে গড়ে ওঠা মিনার্ভা থিয়েটারে যোগদান করেন, যেখানে পূর্বে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ছিল।  তখন গিরিশচন্দ্র মিনার্ভার দায়িত্ব নিয়েছেন এবং ম্যাকবেথ প্রযোজনার প্রস্তুতিতে মগ্ন। অর্ধেন্দুশেখর চারটি বিভিন্ন ভূমিকায় নির্বাচিত হলেন যথা- উইচ, ওল্ড ম্যান, পোর্টার, এবং ফিজিশিয়ান। এই ছোট পার্টগুলিতে অসাধারণ অভিনয় করার জন্য  তিনি প্রশংসিত হলেন। তবে গিরিশচন্দ্রের পরবর্তী প্রযোজনা 'আবু হোসেন'-এ অর্ধেন্দুশেখরের কৌতুক অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

অর্ধেন্দুশেখর পক্ষপাতিত্ব না করে শিক্ষাদানের অভ্যাস তাকে তার সহকর্মীদের কাছে আদরনীয় করে তুলেছিল। ফলে তিনি নাট্য শিক্ষক হিসেবে অভিনেতাদের উপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। তার স্বার্থলেশহীন  কাজ, তার বুদ্ধির দীপ্তি, জাগতিক সুখ সুবিধার প্রতি নিস্পৃহতা, বদান্যতা- এইসবের জন্য তিনি বাংলা থিয়েটারের কাহিনীতে কিংবদন্তি হয়ে আছেন। অর্ধেন্দুশেখরের মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণসভায় গিরিশচন্দ্র আবেগভরে অর্ধেন্দুশেখরের অপরিমীয় ধৈর্য এবং অভিনয় শিক্ষাদানের অন্যান্য কৌশলের কথা বলেছিলেন। ক্ষুধা তৃষ্ণা ক্লান্তি ভুলে গিয়ে সময় অসময় খেয়াল না করে তিনি অভিনয় শিক্ষা দিতেন। তিনি নতুন শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট পার্ট তৈরি করতে এবং তাদের অভিনয় শিল্পের আশ্চর্য কলাকৌশল সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতেন। নাট্যশিক্ষক হিসেবে রঙ্গালয়ে ৩০ বছরে অমরেশচন্দ্র লিখেছেন অর্ধেন্দু শেখর ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

শিশির ভাদুড়ি তো এমন কথাও বলেছিলেন যে, চরিত্রাভিনেতা হিসেবে তিনি গিরিশচন্দ্র অপেক্ষাও পারদর্শী। যখন তিনি একই নাটকে বিভিন্ন চরিত্রের রূপদান করার জন্য সাজ পোশাক ও রূপসজ্জা দ্রুত পরিবর্তন করে মঞ্চে অবতীর্ণ হতেন তখন দর্শকের পক্ষেও চেনা শক্ত হতো যে একই অর্ধেন্দুশেখর এই ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের রূপ দিচ্ছেন।

১৮৯৫ সালে বড়দিনের সময় নীলদর্পণ অভিনয়ের পর এমারেন্ড থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেলে পরবর্তী ছ'বছর অর্ধেন্দুশেখর মিনার্ভা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একনাগারে নয়, কয়েক দফায়। তিনি বাঙালি দর্শকদের থিয়েটার দেখার অভ্যাসে গড়ে দিতে প্রভূত সাহায্য করেছিল।

অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে নিদ্রাহীনতা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধ না মানার ফলে অচিরেই তার শরীর ভেঙে পড়ে কিন্তু এসব থিয়েটার থেকে তাকে দূরে রাখতে পারিনি।১৯০৮ সালের আগস্ট এ রবিবার দুটি নাটকের ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হবে ঘোষিত হয়েছিল। প্রফুল্ল নাটকে "যোগেশ" এবং দীনবন্ধু মিত্রের নবীন তপস্বিনির "জলধর"। শরীর অসুস্থ এবং মঞ্চে প্রবেশের প্রাক্কালে দাঁড়াবার সামর্থ্য ছিল না। তবুও দায়িত্ব প্রতিপালন করে শেষে অজ্ঞান হয়ে যান এবং ওখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ