শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস চর্চার বিভিন্ন ধারা
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মূলত বিদেশী পু৺জির অনুপ্রবেশ এবং প্রধানত উপনিবেশিক উদ্যোগে বাগিচা, খনি, চটকল, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, বস্ত্র শিল্প এবং ইস্পাত ও রেল এর মত নতুন ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার পরে, ভারতের সর্বপ্রথম স্পষ্টত এক নতুন সামাজিক শ্রেণী হিসেবে শিল্প শ্রমিকদের আবির্ভাব ঘটে। যদিও কৃষি প্রধান ভারতবর্ষে মোট জনসংখ্যার তুলনায় সংখ্যাগতভাবে শিল্প শ্রমিকের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। ঘটনাচক্রে ভারতবর্ষে এই শিল্প শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব সেই সময়ে শুরু হয়, যে সময়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
গোড়ার দিকে শ্রমিক ও তাদের আন্দোলনের মূল ধারা ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে তেমনভাবে আকর্ষণ করেনি। কারণ তারা শ্রেণী-সম্প্রদায় নির্বিশেষে ভারতীয়দের একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁদের মতে রাজনীতিবিদরা অনেক সময়ই শ্রমিকদের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এবং তাদের নিজেদের কোনো বিশেষ রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল না। ফলে ঐতিহাসিকগণ, জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা সম্বন্ধে তেমন শ্রদ্ধা পোষণ করতেন না।
উপনিবেশিক ভারতে শ্রমিক ইতিহাস চর্চা শুরু হয় মোটামুটি ১৯২০ দশক থেকে। প্রথমদিকে অবশ্য শ্রমিক আন্দোলনের তুলনায় শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অবস্থা, তাদের কাজের পরিবেশ, খাদ্য, বাসস্থান ও সংশ্লিষ্ট সমস্যাই প্রধানত অর্থনীতিবিদদের ও সমাজতত্ত্ববিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এই পর্বের উল্লেখযোগ্য গবেষণাকারীদের মধ্যে আছেন রজনীকান্ত দাস। তাঁর রচনা ছিল "ফ্যাক্টরি লেবার ইন ইন্ডিয়া"। আরও রয়েছেন জে এম ব্রাউটন, দেওয়ান চমনলাল, বি শিবারাও, কে. পি. চট্টোপাধ্যায়, রাধাকমল মুখার্জি, কে. এম. মুখার্জি প্রমুখ পণ্ডিত। এঁরা সামগ্রিকভাবে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা অধিকাংশ গ্রন্থে আলোচনা করলেও বেশ কয়েকটি রচনায় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রের শ্রমিকদের বেছে নিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে গবেষণা শুরু হলেও এই ক্ষেত্রেও প্রথাগত ঐতিহাসিক এর পরিবর্তে অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে রজনীকান্ত দাস এর "লেবার মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া" আহমেদ মুখতার এর "ট্রেড ইউনিয়ন এন্ড লেবার ইন ইন্ডিয়া" এবং এস ডি পুনেকর ও গৌতম শর্মার নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭০ দশক পর্যন্ত শ্রমিক ইতিহাস চর্চাকারীরা শ্রমিক আন্দোলনকে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করতেন। এর ফল হল যে অঞ্চলভেদে আন্দোলনগুলির যেসব বৈশিষ্ট্য ও জটিলতা ছিল সেগুলি সার্থকভাবে আলোচনার সুযোগ হত না। তাছাড়া এ ধরনের বৃহৎ বর্ণনায় সব সময় জোর পড়ত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের নেতৃত্বের উপর ।
ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এক যুগান্তর আছে আসে ১৯৭০ দশক থেকে, যখন বেশ কয়েকটি নতুন গবেষণা প্রকাশিত হতে থাকে। শ্রমিক আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন ধারার সৃষ্টি করে। এর একটি হল ব্যাপক সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে না গিয়ে সময়, অঞ্চল এবং শিল্পভিত্তিক অনেক সীমাবদ্ধ বিষয় নিয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা শুরু হয়।
বোম্বাইয়ের সুতা কল শ্রমিকেরা ঐতিহাসিকদের সম্প্রীতিকালে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই প্রসঙ্গে মরিস ডি মরিস, আর কে নিউম্যান, ডিক কুইম্যান, আর এস চন্দ্রভারকার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিউম্যান এবং কুইম্যান তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু রেখেছেন দুই মহাযুদ্ধের অন্তবর্তী কাল। লিটেন তার আলোচনা শুধুমাত্র ১৯৩০ দশকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন।
বোম্বাই সুতাকল শ্রমিকদের উপর যারা সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তারা হল বাংলার চটকল শ্রমিকরা। এই সম্পর্কিত গবেষণার মধ্যে দীপেশ চক্রবর্তী, রনজিত দাশগুপ্ত, অমল দাস, নির্মাণ বসু, পরিমল ঘোষ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে কয়েকটি রচনা শুধু শিল্প ভিত্তিক নয়, শিল্পের মধ্যেও একটি বিশেষ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে রচিত। যেমন অমল দাস হাওড়া ও দা হান টিটাগর শিল্প অঞ্চল সম্বন্ধে গবেষণা করেছেন।
বোম্বাইয়ের সুতাকল ও বাংলার চটকল শ্রমিক ছাড়াও অন্যান্য অঞ্চলের শিল্প ভিত্তিক শ্রমিক আন্দোলন নিয়েও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গবেষণা আছে। যেমন আসামের চা বাগানের শ্রমিক নিয়ে অমলেন্দু গুহ "প্লান্টার রাজ টু স্বরাজ" এবং রানা প্রতাপ বেহাল ডুয়ার্সের চাষ শ্রমিক নিয়ে "থার্ড ক্লাস ফর্ম ইন প্লান্টেশন সিস্টেম "।
ইতিহাস চর্চার আরেকটি নতুন ধারা হলো পাশাপাশি ও কাছাকাছি অবস্থিত একাধিক শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করা। যেমন ইয়ামন মার্ফি দক্ষিণ ভারতের চারটি সুতাকল অঞ্চলের শ্রমিকদের নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। নির্বাণ বসু বাংলার সুতাকল, চা-বাগান, কয়লা খনি, ইস্পাত শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছে।
একটি প্রদেশকে ভিত্তি করে শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রগতি বিশ্লেষণের চেষ্টা হয়েছে; যেমন বাংলার ক্ষেত্রে পঞ্চানন সাহা "হিস্ট্রি অফ দা ওয়ার্কিং ক্লাস মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল" এবং তামিলনাড়ু নিয়ে সি এস কৃষ্ণ "লেবার মুভমেন্ট ইন তামিলনাড়ু"
আরো এক ধরনের ইতিহাস চর্চা হল শ্রমিক শ্রেণীর গড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠা এবং আন্দোলনে নামাকে একটি নির্দিষ্টকাল সীমার মধ্যে ফেলে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। কিভাবে উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুতে একটি সামাজিক শ্রেণী হিসেবে প্রথম শ্রমিক শ্রেণী গড়ে উঠলো, তার বিশ্লেষণ করেছেন আত্মসারথি গুপ্ত, অমিয় কুমার বাগচি প্রমুখরা।
জাতীয় আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে প্রথম যোগসূত্র খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও স্থাপিত হয়েছিল। ১৯০৫-০৮ এর স্বদেশী আন্দোলনের সময় এর বর্ণনা আমরা পাই সুমিত সরকারের "দ্য স্বদেশী মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল" এবং সোভিয়েত ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে শ্রমিক আন্দোলন ও জাতীয় আন্দোলন সম্পর্ক নিয়মিত জটিল ও আঁকাবাঁকা হয়ে ওঠে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে সেই সম্পর্ক ধরার চেষ্টা করেছে রাখি হরি চট্টোপাধ্যায়, পি পি লাক্সমান, জি রামানুজন, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, সত্যব্রত রায়চৌধুরী প্রমুখরা।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অর্থাৎ বিগত ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের শ্রমিক আন্দোলনের উপর বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা হলেও এই সময়ে কোন সামগ্রিক বিবরণ এখনো অনুপস্থিত। আর বিশাল অসংগঠিত ক্ষেত্র দিন মজুর, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, নির্মাণ শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক, ঝাড়ুদার এখনো গবেষকদের দৃষ্টির বাহিরে। নারী শ্রমিক কর্মচারীরাও বিশেষ ও পৃথক আলোচনার দাবি রাখেন। মঞ্জু চট্টোপাধ্যায় তার একাধিক প্রবন্ধে সর্বোচ্চ স্তরের মহিলা নেত্রীদের যাদের অধিকাংশ ছিলেন উচ্চ বর্গীয় সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবার স্বীকৃত সম্প্রদায়ের মানুষের কথা আলোচনা করেছেন। আবার শমিতা সেনের লেখায় একেবারে তৃণমূল স্তরের নারী শ্রমিকদের কথা উল্লেখ আছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন