সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কলকাতা ও তার আশেপাশের গণিকা পল্লী

কলকাতা ও তার আশেপাশের গণিকা পল্লী সম্পর্কে আলোচনা কর?

ব্রিটিশ কর্তৃক বাংলার শাসনভার গ্রহণের পর নতুন বাণিজ্যিক এবং প্রশাসনিক সম্পর্কের প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রাক উপনিবেশিক আর্থসামাজিক বিন্যাসের সাথে সাযুজ্য রেখে বাংলায় গণিকাবৃত্তিরও প্রবর্তন ঘটে।

উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে গনিকা বৃত্তির সংগঠনের প্রসারণ এবং খরিদ্দারদের বিভিন্ন বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। কলকাতার বাইরে বাংলার মফঃস্বল শহরগুলি তেও পর্যাপ্ত গণিকালয়ের অভ্যুদ্বয় দেখা যায়। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় চার লক্ষ জনসাধারণ ১২,৪১৯ জন গণিকাকে পালন করেছিল। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা ৩০ হাজারে এসে দাঁড়ায়।

১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত ব্যঙ্গ রচয়িতা কালীপ্রসন্ন সিংহ তার রচনায় অলস ধনী পুরুষদের জীবনযাত্রা ও তাদের ব্যবহার সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন যে এই সমস্ত ধনী ব্যক্তিদের জন্য কলকাতা একটি গণিকালয়ে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেক লোকালয়ে কমপক্ষে দশটি করে গনিকালয় থাকত। প্রতিবছর গণিকাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেত।

কলকাতা ও অন্যান্য অঞ্চলে গণিকাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংগঠনের পরিবর্তন ঘটেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। গণিকা সম্প্রদায়ের প্রথম প্রজন্ম ছিল বিভিন্ন স্থানচুত্য মহিলা কিংবা মধ্যবিত্ত কুলীন ব্রাহ্মণের পরিবারের প্রত্যাখ্যান কন্যা । পরিশেষে এদের স্থান হত গণিকালয়ে। এই সময় গণিকাদের নতুন প্রজন্মের উত্থান দেখা যায় যারা পূর্ববর্তী গণিকাদের কন্যা সন্তান। চলিত বাংলায় এদের 'ডবল খানকি' বলে অভিহিত করা হয় আরও একটি উৎস হল নিম্ন বংশজাত বহু দরিদ্র মহিলা যারা গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কলকাতা বা  মফঃস্বল শহরে বাঙালি মধ্যবিত্তের গৃহে বা নবপ্রতিষ্ঠিত কারখানায় কাজের লোক হিসেবে এসেছে তারা স্বল্প উপার্জনের অভাব পূরনার্থে সন্ধ্যায় গনিকাবৃত্তি করত। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সরকারি প্রতিবেদনে এদের সাত ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্সি বিভাগে অর্থাৎ কলকাতা ও সন্নিকটস্থ জেলাগুলির গণিকাদের গঠন সম্বন্ধে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে নিম্ন বংশজাত দরিদ্র হিন্দু ও খ্রিস্টান গণিকাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরা ছিল প্রধানত তাঁতি ,মালি, কুমোর, কামার, চামার, বেনে, তেলি, জেলে কৈবর্ত, ময়রা গোয়ালা, নাপিত ইত্যাদি  সম্প্রদায়ভুক্ত।

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখক দুর্গাচরণ রায়ের ভ্রমণের মধ্যে কলকাতার বিভিন্ন শ্রেণীর গণিকাদের বাসস্থান তাদের খরিদ্দার ও বিভিন্ন কর্মপদ্ধতির চিত্র পাওয়া যায়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...