ঔপনিবেশিক ভারতের শ্রমিক সরবরাহের উৎস
উনবিংশ শতাব্দীর শেষআর্ধ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এই অন্তবর্তীকালীন সময়ে ভারতবর্ষে এক নতুন সামাজিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল। এই শ্রেণী শিল্পের নিযুক্ত শ্রমিক শ্রেণী নামে ভারতের ইতিহাসে পরিচিত। ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে শ্রমিক শ্রেণী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনে উপনিবেশিক স্বার্থ পূরণ করার জন্য প্রাচীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছিল এবং এর পরিবর্তে গড়ে উঠেছিল আধুনিক শিল্প এবং পাশ্চাত্য অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা। এবং তা হয়েছিল অত্যন্ত ধীরগতিতে ও বাধাগ্রস্থ পথে। সামন্ততন্ত্রের অবসানের পর ইউরোপে যেভাবে আধুনিক ধনতন্ত্র ও শিল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তার থেকে ভারতে ধণতন্ত্র ও আধুনিক শিল্প প্রতিষ্ঠার পথ ছিল ভিন্নতর। অবশ্যই মনে রাখার প্রয়োজন এ দেশে শিল্প ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের মধ্য দিয়ে।
ভারতে আধুনিক শিল্পের উদ্ভব ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ঘটনা হলো রেলপথের প্রতিষ্ঠা। এর সূত্র ধরে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ ভারতের প্রধান প্রধান শহরগুলিতে নানা আধুনিক শিল্পের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। পাট শিল্প, বস্ত্র শিল্প, কয়লা শিল্প ছাড়াও অনেক মাঝারি শিল্প এ সময় গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৮৫০ থেকে ৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ভারতে আধুনিক শিল্পের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল বলে মোটামুটি ভাবে বলা হয়। তাই ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভবের কাল এটাই। পরবর্তী বছরগুলিতে ভারতের শিল্পায়নের অগ্রগতির সাথে সাথে শ্রমিক শ্রেণীরও শ্রেণী হিসেবে প্রসার ঘটতে থাকে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে কলকাতা ও তার আশেপাশে হুগলি ও ২৪ পরগনায় পাটকল বিস্তার লাভ করেছিল। এগুলি গড়ে উঠেছিল মূলত ব্রিটিশ পুঁজি ও মালিকাধীনে। ১৯১৩-১৪ সালে ভারতে মোট ৬৪ টি পাটকল স্থাপিত হয়, যার প্রায় সবকটাই গড়ে উঠেছিল বাংলায়। এই ৬৪ টি কারখানার মোট শ্রমিকের সংখ্যা ১৯১৩-১৪ সালে ছিল ২,১৬,০০০। পাটকল গুলির গোড়ার দিকে এর সংখ্যা ছিল মাত্র ২৭,৪৯৪ এর কাছাকাছি।
হুগলি নদীর উভয় তীরে গড়ে ওঠা পাটকলগুলিতে উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে স্থানীয় বাঙালি শ্রমিকরাই কাজ করতো। এরা কলকারখানার আশেপাশে গ্রাম থেকে কাজ করতে আসতো। এছাড়া পার্শ্ববর্তী জেলাগুলি থেকেও অনেক মানুষ পাটকলে শ্রমিকের কাজে নিযুক্ত ছিল। ১৮৯৫-৯৬ সালে পাটকল গুলিতে বৈদ্যুতিক আলোর প্রচলনের ফলে শ্রমিকের চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে শ্রমিক সংগ্রহের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বিংশ শতাব্দীর সূচনা পর্বে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। স্থানীয় বাঙালি শ্রমিকদের স্থান দখল করে নেয় বহিরাগত বিভিন্ন প্রদেশের অবাঙালি মানুষেরা। এইসব মানুষেরা অধিকাংশই এসেছিল পশ্চিম বিহার ও উত্তর প্রদেশের পূর্বপ্রান্ত থেকে। এছাড়াও উড়িষ্যার কটক থেকে এবং মাদ্রাজ থেকেও বহু মানুষ শ্রমিকের কাজ করতে কলকাতা এসেছিল। ১৯৩০-৩১ সালে এই বিষয়টি রয়েল কমিশন অন লেবার ইন ইন্ডিয়ার দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। তারাও কলকাতা ও তার আশেপাশে পাটকল গুলিতে অবাঙালি বহিরাগত শ্রমিকদের সংখ্যাগত প্রাধান্যের কথা বলতে দ্বিধা করেননি। বুকানন অনুসন্ধান করে জেনেছিলেন যে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার কোন একটি পাটকলে শতকরা ৮০ জন শ্রমিক ছিল বাঙালি। কিন্তু ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে এই হার শতকরা মাত্র ২৫ জন।
১৯০৬ সালে বাংলার সরকার কর্তৃক নিয়োজিত ইংরেজ বিশেষজ্ঞ B Fobley র প্রতিবেদনেও এর সত্যতা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল Fobley তার রিপোর্ট লেবার ইন বেঙ্গল এ ১৯০৬ এই অভিমত দেন যে "Twenty years ago all the hands were bengaless" অবশ্য ১৯০৪-৫ খ্রিস্টাব্দে থেকে অবস্থার সম্পূর্ণ বদলে যায় নতুন নতুন পাটকল গড়ে ওঠার সাথে সাথে দলে দলে বহিরাগত শ্রমিকরা বাংলার পাটকল গুলিতে তাদের সন্ধানে আসে।
পশ্চিম বিহার ও উত্তরপ্রদেশের পূর্ব প্রান্ত থেকে দলে দলে বাংলায় শ্রমিক এসেছিল। এর বেশ কিছু কারণ জানা গেছে। ভূমির উপর অধিক চাপ, ভূমিহীনদের ভূমির অভাবে আর্থিক দৈন্য, বিকল্প কাজের অভাব, জমির চাষের তুলনায় যোগদানের পরিমাণে সল্পতা, দুর্ভিক্ষ, ক্ষরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত কারণ, দিনের বোঝা নানা কারণে এরা গ্রাম থেকে আসতে বাধ্য হয়েছে। ওই সময়কার বিভিন্ন সেটেলমেন্ট রিপোর্ট থেকে জানা যায়, যারা এসেছিল তাদের কোন জমি জায়গা ছিল না, আর যাদের সামান্য কিছু জমি জায়গা ছিল তারা দুবেলা ভালো করে দু'মুঠো খাওয়া হতো না। এর ফলে চাহিদার তুলনায় শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি হওয়ার পরিমাণে পাটকলের মালিকেরা সস্তায় নিযুক্ত করতে পারত। আবার অন্যদিকে সামাজিক অবহেলা, জাত পাতের দ্বন্দ্ব, উচ্চযাতের লোকেদের অত্যাচার, ধর্মের গোড়ামী অনেকে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এসেছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন