স্ত্রী শিক্ষার অগ্রগতিতে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা আলোচনা কর?
ঐতিহ্যিক দিক থেকে শিক্ষার অর্থ ছিল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠ। হিন্দুদের মধ্যে পুরোহিত শ্রেণির অন্তর্গত ব্রাহ্মণরা ধর্মশাস্ত্রের সকল শাখা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করত। অপরদিকে দুই জাত, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যগন ততটা কঠোরভাবে পাঠ গ্রহণ না করলেও ব্যবহারিক দক্ষতার জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতেন। শূদ্র এবং নারী ধর্মশাস্ত্র পাঠ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। উচ্চ শ্রেণীর কিছু পরিবারে কিছু নারী পৌরাণিক সাহিত্য পাঠ করতে শেখেন। মুসলিম নারীরা কোরান শিক্ষা করবেন আশা করা হত। কিন্তু উচ্চ শ্রেণীর মুসলিম পরিবার তাদের কোনো কন্যা সন্তানদের বিদ্যালয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। ফলে ধর্ম সম্বন্ধে তারা যে শিক্ষা পেত তার গৃহ বা পরিবারের কাছ থেকে অথবা গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা ছিল একেবারেই নগন্য।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেরানী ও অনুবাদকের প্রয়োজনে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার সূত্রপাত ঘটায়। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তরুণ ভারতীয়দের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সহকারী পদের জন্য উপযুক্ত করে তোলার উদ্দেশ্যে। পুরুষ বিদ্যালয়ের জন্য সহায়তা করার ক্ষেত্রে যতটা উৎসাহ দেখা গেছিল বালিকাদের ক্ষেত্রে তা ছিল না । মিশনারিগণ স্ত্রী শিক্ষা ও বালিকা বিদ্যালয় এর ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন কারণ তাদের যুক্তি ছিল নারীকে স্থায়ীভাবে কথোপকথনের যোগ্য করে তোলা প্রয়োজন।
১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠাতার পর স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয় ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি। সোসাইটির সম্পাদক হিসেবে রাধাকান্ত দেব ছিলেন স্ত্রীশিক্ষার একজন পৃষ্ঠপোষক এবং তিনি ক্যালকাটা ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে চার্চ মিশনারি সোসাইটি মিস কুককে কলকাতায় এনে সম্ভ্রান্ত বংশের হিন্দু বালিকাদের জন্য ৩০ টি বালিকা বিদ্যালয় খোলেন। এইসব বিদ্যালয়গুলি হিন্দু ভদ্রলোকদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত করা হয়।
দক্ষিণ ভারতে চার্চ মিশনারি সোসাইটি অনেকটা সফল হয় এবং তারা ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে তিরুনেলভেলিতে প্রথম বালিকাদের আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করে। ১৮৪০ এর মধ্যে স্কটিশ চার্জ সোসাইটি ছয়টি বিদ্যালয় চালু করে যাতে ২০০ জন হিন্দু বালিকা ছাত্রী হিসেবে যোগ দেয়। শতাব্দীর মধ্যভাগে মাদ্রাজে মিশনারীরা প্রায় ৮০০০ বালিকাকে শিক্ষা দিতে থাকে।
একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বালিকা বিদ্যালয় ছিল হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়, যা বেথুন কর্তৃক ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। বেথুন ছিলেন গর্ভনর জেনারেল কাউন্সিলের বৈধ সদস্য এবং কাউন্সিল অফ এডুকেশনের সভাপতি। বিদ্যালয়টি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। শিক্ষার মাধ্যম ছিল বাংলা। বালিকাদের ঢাকা গাড়িতে করে বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হতো, যার গায়ে সংস্কৃত শ্লোক লেখা থাকতো এবং এর অর্থ ছিল কন্যা শিক্ষাদান একজন পিতার পবিত্র কর্তব্য। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় ৮০ জন ছাত্রী পাওয়া যায়। হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে পুরানো বেথুন ইস্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বেথুন কলেজে পরিণত হয় এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পায় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ও চন্দ্রমুখী বসু বেথুন কলেজ থেকে বি.এ. ডিগ্রী লাভ করেন এবং তাঁরা ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট ছিলেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন