বাংলা থিয়েটারে শিশির কুমার ভাদুডির অবদান
গিরিশ ঘোষের মৃত্যুর পর পরবর্তী দশক বাংলা থিয়েটারের পক্ষে অন্ধকার একটা সময়। নিরাপদ রাস্তায় চলতে গিয়ে নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার সাহস হারিয়েছিল থিয়েটার। ফলে যে উত্তেজনা এবং আবেগ এর চালিকাশক্তি ছিল তারই পুনঃব্যবহারে ভাঁরাল খালি হয়ে গেল। গিরিশ ঘোষ এর মৃত্যুর পরে সমস্যাগুলি প্রকট হতে লাগলো।
থিয়েটার পাল্টাইনি, কিন্তু থিয়েটারের দর্শক ততদিনে পাল্টে গেছে। নাট্য ব্যক্তিত্বরা যখন একে একে মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে থাকলেন অথবা নতুন ভাবনাচিন্তার ক্ষমতা হারালেন। তখন এমনকি নিতান্তই সাধারণ দর্শকের কাছেও এই থিয়েটারের একঘেয়েমি প্রকট হতে লাগলো। অমরেন্দ্রনাথ, অমৃত মিত্র, অমৃতলাল বসু, পূর্ব যুগের নটগোষ্ঠী তখন রঙ্গমঞ্চ থেকে অবসর নিয়েছে। রঙ্গমঞ্চের হস্তান্তর হচ্ছিল ঘন ঘন এবং অনেক বেশি টাকায়। পুরানো বেঙ্গল থিয়েটার পরপর মালিকানা ও নাম বদলায় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে মালিকের নামে নামাঙ্কিত হয়ে এটি মনোমোহন থিয়েটার নামে উদ্বোধন হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের পর এটি হাতে নেন শিশির ভাদুড়ি। তিনি বিংশ শতাব্দীর থিয়েটারে বিবর্তনের ধারা এনেছিলেন।
শিশির ভাদুড়ি ছিলেন আধুনিক বাংলা নাট্যজগতের পথিকৃৎ, খ্যাতনামা অভিনেতা এবং নাট্যকার। গিরিশচন্দ্র ঘোষের পর তিনি বাংলা রঙ্গমঞ্চের কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব। তিনিই বাংলা নাটকের স্বর্ণযুগে প্রথম নাটকের সেট তথা মঞ্চসজ্জা ও আলোর ব্যবহার প্রবর্তন করে নাট্যশিল্পীদের কর্মকুশলতাকে এক বাস্তবতার ও প্রকৃতির আঙ্গিকে উত্তরণের পথ দেখিয়ে গেছেন।
শিশির ভাদুড়ী প্রথম অভিনয় করেন ছাত্র অবস্থায় তার কলেজের "জুলিয়াস সিজার" প্রযোজনায় ব্রুটাস এর চরিত্রে। ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে পরবর্তী বছর গুলিতে এই অভিনয় চর্চা করার সুযোগও তিনি পান ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের সদস্যরূপে। ক্যামব্রিজ এবং অক্সফোর্ড ইউনিয়নের অনুকরণে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে গঠিত এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল তরুণদের উন্নততর প্রশিক্ষণ। এদের কার্যধারার অন্যতম অঙ্গ ছিল নাট্য প্রযোজনা। শিশির ভাদুড়ী এতে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯১১ সালের সেপ্টেম্বরে ডি এল রায় এর "চন্দ্রগুপ্ত" নাটকে চাণক্যের ভূমিকায় তার অভিনয় চাঞ্চল্যে সৃষ্টি করে। সেই অভিনয়ের দর্শকের মধ্যে ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
তার স্ত্রীর অকাল মৃত্যুর পরের কয়েক বছর শিশির কুমার থিয়েটারে কোন উৎসাহ দেখাননি। তবে এটা ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল। শীঘ্রই তিনি শিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে পেশাদারী অভিনেতা হিসেবে রঙ্গমঞ্চে যোগ দিতে মনস্ত করেন। একজন শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোক্যের পক্ষে এ ছিল এক প্রায় পাগলামি। অকল্পনীয় একটি সিদ্ধান্ত।
কর্নওয়ালিস থিয়েটারে নাট্য মন্দিরের স্থায়িত্বকালে চার বছরের কিছু কম সময়ে শিশির ভাদুড়ী তার গৌরবের মধ্যগগন স্পর্শ করেন। এখানেই তার শ্রেষ্ঠ কয়েকটি প্রয়োজনা মঞ্চস্থ হয় এবং ব্যক্তিগত অভিনয়ে তিনি দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন। সীতা ছাড়াও এখানে তিনি করেন ক্ষীরোদ প্রসাদের পৌরাণিক নাটক 'নরনারায়ণ' এবং যোগেশ চৌধুরীর ঐতিহাসিক নাটক 'দিগ্বিজয়ী' । পুরানো বিখ্যাত কিছু নাটকের পূর্ণমঞ্চস্থ করেন। যেমন দীনবন্ধু মিত্রের 'সধবার একাদশী', গিরিশচন্দ্র ঘোষের 'প্রফুল্ল' এবং 'বলিদান', ডি এল রায়ের 'শাহজাহান' ইত্যাদি। এখানেই তিনি উপন্যাসিক শরৎচন্দ্রকে নাট্যকার হিসেবে নিয়ে আসেন এবং রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি নাটক মঞ্চস্ত করেন। কয়েক মাস পরে লিজ দিতে রাজি না হওয়ায় এই মঞ্চও তাকে ছাড়তে হয়।
১৯৪৮ এ সুযোগ এলো অন্য আরেকটি থিয়েটার লিজ নেবার। দায়িত্ব নিয়ে তিনি এবার থিয়েটারের নাম দিলেন শ্রীরঙ্গম। প্রায় ১৫ বছর তিনি এখানে ছিলেন। এতদিন কোনো এক জায়গায় তিনি থাকেননি। এই দীর্ঘ ১৫ বছরের তিনি এখানে করেছেন নতুন এবং পুরানো ভালো খারাপ মাঝারি সব রকমের নাটক। বাংলাদেশ এবং কলকাতা ততদিনে ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতা সম্মুখীন হয়েছে। নাটকের পর নাটক তার আর্থিক দিক দিয়ে অসফল হতে থাকলো। দেনা বাড়তে থাকল ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তাকে মঞ্চটি ছেড়ে দিতে হলো। তিন বছর পর ১৯৫৯ সালের ২৯ শে জানুয়ারি তিনি মারা গেলেন।
নাট্য জীবনের শুরু থেকেই অসীম জনপ্রিয়তার অধিকারী। শিশির ভাদুড়ী সারা জীবনই অজস্র প্রশংসা পেয়েছেন। বিখ্যাত এবং অবিখ্যাত সব রকমের মানুষই তাকে স্বীকৃতি জানিয়েছেন। বাংলা পেশাদারী থিয়েটার সম্পর্কে যার বিশেষ প্রেম ছিল না সেই রবীন্দ্রনাথও শিশির ভাদুড়ী কে প্রশংসা করেছেন এবং উৎসাহ জুগিয়েছেন। ডঃ সুনিতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে সমকালীন অগ্রগণ্য ভারতীয়দের মধ্যে তার স্থান ছিল প্রশ্নাতীত।
শিশির ভাদুড়ীর অভিনয়ে সর্বপ্রথম লক্ষণীয় হচ্ছে অভিনয়কর্মে মস্তিষ্কের ব্যবহার। বাংলা থিয়েটারের অভিনয়ের ঐতিহ্য ছিল আবেগময়তা, বিরোচিত ভঙ্গিমা এবং অতিসহ্য। কলকাতার পেশাদারী রঙ্গমঞ্চের বড় বড় অভিনেতারা এই যাত্রা রীতির অভিনয় ত্যাগ করেননি। কারণ এই ভঙ্গি দর্শকের বড়ই পরিচিত এবং প্রিয় ছিল। নিষ্ঠা, প্রস্তুতি, নাটক বুঝার চেষ্টার কোন আন্তরিকতার অভাব ছিল না। কিন্তু শিশির ভাদুড়ির মতো ক্ষুরধার বুদ্ধি এদের কারোর ছিল না এবং অভিনয়ে সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণে বুদ্ধির ব্যবহার এদের অজানা ছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন