১৮৭৭ এর সাৎসুমা বিদ্রোহ
মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর মেইজি কর্তৃপক্ষ জাপানে সামন্ত ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, যেগুলি সরাসরিভাবে জাপানের ঐতিহ্যগত সামরিক শ্রেণী সামুরাইদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছিল। এর প্রতিক্রিয়াই ছিল একেরপর এক সামুরাই বিদ্রোহ, যার মধ্যে অন্যতম ছিল সাৎসুমা বিদ্রোহ (১৮৭৭ খ্রি:)।
জাপানের মোট জনসংখ্যা ৩৪ মিলিয়নের মধ্যে ১.৭৫ মিলিয়ন ছিল সামুরাই। টোকুগাওয়া যুগে দীর্ঘদিন ধরে কোন যুদ্ধ না থাকায় সামুরাই শ্রেণীর একটা বড় অংশ তাদের দীর্ঘ অবসর সময়ে নিজেরা নিজেদেরকে শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং প্রশাসন ব্যবস্থায় নিযুক্ত করেছিল। তাই বহু সামুরাই প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজেদের ভবিষ্যৎ খুঁজে নিয়েছিল। কিন্তু তখনও একটা বড় অংশই থেকে গেছিল যারা পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় সামরিক কাজের উপর নির্ভরশীল ছিল। মেইজী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সামুরাইদের মাইনে বন্ধ করে দিয়ে পেনশনের ব্যবস্থা করে এবং কিছুদিন পরে সেই পেনশন বন্ধ করে দিয়ে এককালীন একটা টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এর ফলে সামুরাইদের জীবনযাত্রার মানের অবনতি হয়। দ্বিতীয়তঃ মেইজি সরকার আইন জারি করে যে, একমাত্র রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী এবং পুলিশ ছাড়া কেউ অস্ত্র রাখতে পারবে না। ফলে সামুরাইদের চিরাচরিত অস্ত্র বহনের অধিকার খর্ব হয়। তৃতীয়তঃ সরকার এক আইন জারি করে ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে সামরিক বাহিনীতে সমস্ত শ্রেণীর মানুষ যোগ্যতা থাকলেই যোগদান করতে পারবে। ফলে এতদিন সামুরাই শ্রেণী সামরিক কাজে যে একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করে এসেছিল তা ধ্বংস হয়। এই সমস্ত কারণে সামুরাইরা ক্ষুব্ধ ছিল এবং তারা বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিল।
১৮৭৭ সালের সামুরাই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন সাইগো তাকামোরি। সাইগো তাকামোরি সাতসুমা গোষ্ঠীভুক্ত নেতা ছিলেন এবং মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু মেইজি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার মতবিরোধ দেখা দেয় কোরিয়া অভিযানকে কেন্দ্র করে। সাইগোর বক্তব্য ছিল, জাপানের উচিত কোরিয়াতে অভিযান করা, কারণ এর ফলে জাপানের রাষ্ট্রীয় সম্মান বৃদ্ধি পাবে এবং দীর্ঘ দিন ধরে বসে থাকা সামুরাই শ্রেণী এই অভিযানে যুক্ত হয়ে নিজেদের হতাশা দূর করতে পারবে। কিন্তু মেইজি সরকারের তুলনামূলক নরমপন্থী গোষ্ঠী, যাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন চোসু গোষ্ঠীভুক্ত ইয়ামাগাতা ওরিতোমো, এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিল। শেষ পর্যন্ত নরমপন্থীরা জয়যুক্ত হয় এবং সাইগো ও তার অনুগামীরা পদত্যাগ করেন।
১৮৭০ এর সংস্কারকে কেন্দ্র করে আবার বিরোধ তীব্র হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, পদত্যাগের পর সাইগো তাকামোরি নিজেকে শিক্ষার প্রসারে নিয়োজিত করেন। তিনি ঐতিহ্যের পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন। যাইহোক সাইগোর নেতৃত্বাধীন সৎসুমা বিদ্রোহ দমনের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছিলেন চোষু নেতা ইয়ামাগাতা ওরিটোমো। যুদ্ধক্ষেত্রে সাইগো আহত হন এবং তাঁরই অনুরোধের তাঁর অনুগামী তাঁকে হত্যা করেন।
সাৎসুমা বিদ্রোহ ছিল জাপানে সামন্ততন্ত্র রক্ষার শেষ বিদ্রোহ। সাৎসুমা বিদ্রোহ দমন করার মাধ্যমে মেইজি সরকার কেবল সামন্ততন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক পুতলেন না, এও প্রমান করলেন যে জন্মগত ঐতিহ্য নয়, যুদ্ধ জয়ের মূল মন্ত্র হল প্রকৃত অনুশীল, যা আধুনিক সামরিক ব্যবস্থার প্রধান অঙ্গ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন