আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (IMF)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে যে অর্থনৈতিক অবক্ষয়, অনিশ্চয়তা ও সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাকে আরো জটিল ও ভয়াবহ করে তুলল। পরবর্তী ইউরোপের অর্থনৈতিক চেহারা কেমন হবে, কিভাবে আর্থিক লেনদেনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে নতুন বিশ্ব, আন্তর্জাতিক অর্থনীতি কোন পথে চলবে, এর চালিকাশক্তিই বা কে হবে-- এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করলেন তৎকালীন মার্কিন বাণিজ্য সচিব হেনরি মর্গানথো। সম্মেলন বসল ১৯৪৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিটন উডসের মাউন্ট ওয়াশিংটন হোটেলে। সারা বিশ্বের ৪৪টি দেশের ৭০০ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করলেন এবং সম্মেলনের প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৪৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার প্রতিষ্ঠিত হলো। ১৯৪৭ সালের ১লা মার্চ থেকে এই সংস্থা তার কাজ শুরু করলো।
আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের একাধিক ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল:
১) আর্থিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহায়তার পরিবেশ সৃষ্টি করা।
২) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো যাতে সদস্য রাষ্ট্রগুলির সর্বাধিক কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটে।
৩) সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে স্থিতিশীল বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বিনিময়ের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য হ্রাস রোধ করা।
৪) সদস্য রাষ্ট্রগুলির উৎপাদনশীল সম্পদ বৃদ্ধি করা।
৫) বিশ্ব বাণিজ্যে বৈদেশিক বিনিময়ের উপরে বাধা-নিষেধ প্রত্যাহার করা।
৬) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে লেনদেনের ভারসাম্যহীনতার হ্রাস করা। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে বৈদেশিক মুদ্রা ঋণ দেবে।
৭) সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে আদান-প্রদানের জন্য চলতি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির জায়গায় বহু পক্ষের ব্যবস্থা গঠন করা।
৮) ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে সর্বোতভাবে সাহায্য করা কারিগরি সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়ন ঘটানো।
৯) অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলিতে পুঁজিবিনিয়োগ বৃদ্ধি করা যাতে তাদের কাঁচামালের সদ্ব্যবহার ঘটে এবং জীবন যাত্রার মান উন্নত হয়।
আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলির আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে বিপুলভাবে সাহায্য করেছে। তবে এই সংস্থা কোনভাবেই সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। কোনো দেশের বৈদেশিক লেনদেন ঘাটতির স্বল্পকালীন ও দীর্ঘমেয়াদী উভয় ধরনের সমস্যা মেটাতে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার শর্তসাপেক্ষে সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে ঋণ প্রদান করে। বলাবাহুল্য শর্তগুলি আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের শক্তিশালী পুঁজিপতি রাষ্ট্রগুলির স্বার্থ সিদ্ধি করে এবং একই সাথে দরিদ্র দেশগুলির অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারে সম্পদশালী দেশগুলির দেয় অর্থের পরিমাণ বেশি। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও বেশি। শর্তাধীন সাহায্যের নামে তারা দরিদ্র দেশগুলিকে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলে। এতে দরিদ্র দেশগুলির অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হয় এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয়। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার থেকে প্রাপ্ত ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা অনেক দেশেরই থাকে না। ফলে সুদের পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় একটা সময় সুদের পরিমাণকে অতিক্রম করে যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন