কিউবা-মার্কিন সম্পর্ক| | Cuba-USA Relationship
ফালজেন্সিও বাতিস্তা দ্বিতীয়বার কিউবায় ক্ষমতা আরোহন করে (১৯৫২) স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিমধ্যে ফিদেল কাস্ত্রো ও তার ভাই রাউল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে প্রতিবাদী আন্দোলন কিউবায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। কাস্ত্রো ভাতৃদ্বয় কিউবায় বেশ জনসমর্থন লাভ করেন। মার্কিন প্রশাসনও বাতিস্তার স্বৈরশাসনে বিরক্ত হয়ে ওঠে। এমন সময় ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফিদেল কাস্ত্রো বিপ্লবের মাধ্যমে কিউবায় ক্ষমতা দখল করেন। প্রথমদিকে কিউবার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক মোটামুটি ভালই ছিল। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে ফিদেল কাস্ত্রো কিউবায় আধুনিকীকরণের জন্য যে একের পর এক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল সেগুলি মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছিল। একই সাথে সোভিয়েত তথা কমিউনিস্ট দুনিয়ার সঙ্গে কাস্ত্রোর সংসর্গ ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর ফলে মার্কিন এর সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল এবং একটা সময় তা সংঘর্ষের রূপ পরিগ্রহ করেছিল।
ফিদেল ক্ষমতায় এসে প্রথম দিকে মার্কিন বিরোধিতার পরিচয় দেননি। বাতিস্তার অপশাসন মার্কিনকে ফিডেলের প্রতি সুহৃদ করেছিল। ফিদেলকে মার্কিন সরকার একজন সংস্কারপন্থী শাসক হিসেবেই দেখেছিল। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফিদেল মার্কিন সফরে গেছিলেন এবং প্যান আমেরিকান ডিফেন্স প্যাক্ট এর অন্তর্ভুক্ত থাকবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। আরও আশ্বস্ত করেছিলেন যে কিউবায় বিদেশি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে না এবং বিদেশি বিনিয়োগেও বাধা দেওয়া হবে না।
কিউবার প্রধান সমস্যা ছিল এর চিনি রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতি। চিনির প্রধান খরিদ্দার ছিল মার্কিন। ফলে বিদেশি অর্থের জন্য কিউবাকে কেবল মার্কিনের বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করতে হত। কিন্তু ফিদেলের একের পর এক আর্থিক ও সামাজিক সংস্কার মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে চলে গেছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিউবা ক্রমশ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র USSR এর কাছে আসছিল। এখান থেকেই মার্কিন কিউবা সম্পর্ক ক্রমশ শীতল হতে শুরু করেছিল।
১৯৫৯ সালে জুন মাসে ফিদেল কিউবাতে কৃষি সংস্কার আইন জারি করে মার্কিন মালিকানাধীন আখের ক্ষেত ও চিনির কারখানাগুলির জাতীয়করণ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর জন্য কিউবার কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে। ১৯৬০ সালে সোভিয়েত বাণিজ্যমন্ত্রী কিউবায় আসেন এবং একটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেন। স্থির হয় যে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাকে খনিজ তেল রপ্তানি করবে এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য প্রদান করবে। ওই বছরই ফিডেলের সহযোগী চে গেভারা পূর্ব ইউরোপ সফর করেন এবং কমিউনিস্ট বলয় থেকে অস্ত্র আমদানি শুরু হয়। কিউবার তেলশোধনাগারগুলি ছিল মার্কিন সমর্থক ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। এরা সোভিয়েত থেকে আমদানিকৃত তেল শোধন করতে অস্বীকার করে। তখন একটি আইন জারি করে তৈল শোধনাগারগুলির জাতীয়করণ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানালে কিদেল আরও একটি আইন জারি করে বলেন যে, যে কোনো মার্কিন সম্পত্তি বিনা ক্ষতিপূরনই সরকারীকরণ করা যাবে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার কিউবার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করে। চিনির আমদানির ৯৫ শতাংশ কমিয়ে দেয় এবং অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য সামগ্রী ও জীবনদায়ী ঔষধ ছাড়া সবই রপ্তানি বন্ধ করে দেয়।
মার্কিন কিউবা সম্পর্কের অবনতি কিউবাকে বেশি করে সোভিয়েতমুখি করে তোলে। সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান ক্রুশ্চেভ ঘোষণা করেন যে কিউবার জনগণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য যে সংগ্রাম চালাচ্ছে তাতে সোভিয়েতের সমর্থন আছে। মার্কিন এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাকে সামরিক সাহায্য প্রদান করবে। প্রকৃতপক্ষে ক্রুশ্চেভ চেয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উঠানেই একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে মার্কিনকে চাপের মধ্যে রাখতে। এদিকে এইসব ঘটনা মার্কিন রাষ্ট্রপতি আয়োজনহাওয়ারের বিরক্তির উদ্রেক করে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম বলয়ে কোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থানকে মেনে নেবে না। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ঘোষণা করে যে কিউবাকে সে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। কিউবার অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে কিউবার ৪ মিলিয়ন টন চিনি আমদানি করতে সোভিয়েত সম্মত হয়। পাশাপাশি কিউবাতে সামরিক সাহায্যও আসতে থাকে। ওই বছর রাষ্ট্রসঙ্ঘের সম্মেলনে ক্রুশ্চেভের সাথেই ফিদেল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিন্দা করেন। তিনি বলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ আমেরিকার স্বৈরতান্ত্রিক সরকার গুলিকে মদত দিয়ে চলেছে এবং এখানকার ঘনঘন সরকার পতনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী।
কিউবার সমাজতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হাওয়া মার্কিনকে আরও তৎপর করে। তাই ১৯৬০ সাল থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার গোয়েন্দা সংস্থার (CIA) সহায়তায় কিউবাতে ফিদেল বিরোধী অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা চালাতে থাকে। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে কিদেল কিউবাকে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। নতুন মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেনেডি কমিউনিস্ট বিরোধী দেশত্যাগীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন ফিদেল বিরোধী অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য। আমেরিকার ফ্লোরিডায় কমিউনিস্ট বিরোধী কিউবানদের একটি রাজনৈতিক কমিটি গঠন করা হয়। মধ্য আমেরিকার গুয়াতেমালায় কমিউনিস্ট বিরোধী কিউবানদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। মার্কিনের উদ্দেশ্য ছিল কিউবাতে ফিদেল বিরোধী গেরিলা যুদ্ধ সংঘটিত করা, প্রয়োজনে মার্কিন বিমান বাহিনী তাদের সাহায্য করবে। অভিযান চালাবার জন্য নিউইয়র্কে কিউবান ন্যাশনাল কাউন্সিল তৈরি হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী কারোদনা। ১৯৬১ সালের ১৭ই এপ্রিল ১৪০০ জনের একটি ছোট বাহিনী Bay of Pigs এ অবতরণ করে। যথাযথ সময়ে মার্কিন সহায়তা না পাওয়ায় ফিদেলের সেনাবাহিনীর কাছে এরা পরাজিত হয়। এই ঘটনার ফলে ল্যাটিন আমেরিকাতে মার্কিন এর ভাবমূর্তি একেবারে ক্ষুন্ন হয়।
আমেরিকা এর পর OAS থেকে কিউবাকে হটানোর চেষ্টা করে। দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে ১৯৬২ সালে কিউবাকে বহিষ্কার করা হয়। তবে ল্যাটিন আমেরিকার ছয়টি প্রভাবশালী দেশ ভোটদান থেকে বিরত থেকেছিল। কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার অপরাধে কিউবার বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া চলবে না --এই যুক্তিতে তারা ভোটদান থেকে বিরত ছিল। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে কিউবার ঘটনা দক্ষিণ আমেরিকায় মার্কিন এর ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছিল। এর ফলে কিউবার সাথে মার্কিনের সম্পর্ক সবথেকে তিক্ত রূপ নেয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাকে সামরিক সহায়তা প্রদানের যে আশ্বাস ইতিপূর্বে দিয়েছিল Bay of Pigs ঘটনার পর তা বাস্তবায়িত হল। ১৯৬২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ৪৮ টি মাঝারি ধরনের ক্ষেপনাস্ত্র, মিগ-২১ এবং ২৮ টি জেট বোমারু বিমান সরবারহ করে। ফলে নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো ও বস্টনের মত আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলি ক্ষেপনাস্ত্রের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়। মার্কিন কংগ্রেস
সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি স্থাপনের সংবাদে বিচলিত হয়ে ওঠে এবং এর জন্য
প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে তার আপসমুখি মনোভাবের জন্য দায়ী করে। কেনেডি তখন তার
টেলিভিশন ভাষণে আকাশ ও নৌপথে কিউবা অবরোধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আরও বলা হয়
পশ্চিম গোলার্ধে কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগ করা হলে
আমেরিকা তা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করবে। এদিকে পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুসারে অস্ত্র
সরবরাহের জন্য সোভিয়েত জাহাজ কিউবার পথেই অগ্রসর হলে ন্যাটো বাহিনী অবরোধ করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন তার অস্ত্র বোঝাই জাহাজ ফিরিয়ে নেয় এবং প্রস্তাব দেন যে
ভবিষ্যতে যদি আমেরিকা কিউবা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং নৌ অবরোধ
প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি অপসারণের
সিদ্ধান্ত নেবে। শেষ পর্যন্ত দুপক্ষই সংযমী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২৭ অক্টোবর, ১৯৬২ সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাতে ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেবে
বলে প্রতিশ্রুতি দেয় । আমেরিকা কিউবা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তুরস্ক থেকেও
ক্ষেপণাস্ত্র গুলিকে সরিয়ে নেওয়ার অপ্রকাশ্য প্রতিশ্রুতি দেয়। এভাবে কিউবা মার্কিন আক্রমণ থেকে মুক্ত হয় এবং এবার থেকে আমেরিকা কিউবাকে সমীহ করে চলতে বাধ্য হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন