বাংলা থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা থিয়েটার এবং বাংলা নাট্যসাহিত্যের নিঃসঙ্গ পথিক। সময়ের দিক থেকে তাঁর স্থান নির্দেশ করা দুরূহ। তেমনি আবার তার থিয়েটার শৈলীর গায়ে কোন প্রচলিত সংজ্ঞার লেভেল এঁটে দেওয়া অসম্ভব। দীর্ঘ সময় জুড়ে তিনি নাটক রচনা করেছিলেন। উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, নাট্যশরীর গঠন, ভাষা এবং ভঙ্গিতে এদের মধ্যে দেখা যায় বিস্ময়কর বৈচিত্র্য। বস্তুত তাদের মধ্যে কয়েকটি আবার নাটকের পরিচিত সংজ্ঞাকেও অতিক্রম করে যায়। তিনি প্রচলিত ধারা থেকে আলাদা। তাঁর নাট্যরচনা ও থিয়েটারের ধারণা গড়ে তুলেছিল এক স্বতন্ত্রের ঐতিহ্য।
রবীন্দ্রনাথ প্রথম মঞ্চাভিনয় করেন ১৮৭৭ সালের এক পারিবারিক অভিনয়ে তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা একটি নাটকে। তাঁর প্রথম প্রকাশ্য অভিনয় অবশ্য ঘটে 'বাল্মিকী প্রতিভা' নাটকে। তাঁর নিজের রচিত এই সাংগীতিক নাটকটি রামায়ণ রচয়িতা মহাকবির জীবন সংক্রান্ত ঘটনাবলী নিয়ে রচিত। যে সমস্ত আমন্ত্রিত দর্শকূল অভিনয় দেখেন তাদের মধ্যে ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ২১। এর পর থেকে দীর্ঘকাল রবীন্দ্রনাথ নিজের রচিত ছোট বড় প্রায় ৪০ টি নাটক প্রযোজনা এবং অভিনয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৩৫ সালে শান্তিনিকেতনে 'শারদোৎসব' অভিনয়ে তিনি শেষ মঞ্চঅভিনয় করেন তখন তার বয়স ৭৫।
সাহিত্যের ইতিহাস প্রণেতারা রবীন্দ্রনাথের নাট্যকর্মকে নানা শ্রেণীতে বিভক্ত করে থাকেন, যেমন গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, প্রহসন, সামাজিক নাটক, প্রতিকী নাটক ইত্যাদি। যে নাটকগুলির উপর নাট্যকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি প্রধানত নির্ভরশীল ছিল সেগুলিরও বৈচিত্র কম নেই। এদের মধ্যে কয়েকটি তাকে পেশাদারী থিয়েটারের কাছাকাছি এনেছিল আবার কয়েকটি দূরে ঠেলে দিয়েছিল। প্রথম যে পূর্ণাঙ্গ নাটক তিনি রচনা করেন তার নাম 'রাজা ও রানী'। কলকাতার পেশাদারী থিয়েটারে তার যে কটি নাটক ইষৎ সাফল্য পেয়েছে এটি তার মধ্যে একটি। ট্রাজেডিয়ান অফ বেঙ্গল নামে খ্যাত মহেন্দ্রনাথ বসু এবং মতিলাল সুর কুমার সেন এবং বিক্রম দেবের প্রধান দুটি চরিত্র অভিনয় করেন। রাজা ও রানী'র পর রচিত হয় 'বিসর্জন'। নিজের একটি পূর্বাতন উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে রচিত এই কাব্য নাটকটি ধর্মের নামে অকারনে রক্তপাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নাটকীয় ঘাত প্রতিঘাত ও ট্রাজিক আবেগে পরিপূর্ণ এই নাটকটির প্রযোজনা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত হিন্দুধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিতে পারে এই ভয়ে।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দের যখন তিনি তার পরবর্তী প্রধান নাটক 'রাজা' রচনা করলেন তখন দেখা গেল আগের নাটকগুলি থেকে এর চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। 'রাজা' দিয়ে শুরু হল নাট্য রচনার এক উজ্জ্বল অধ্যায়। নিটোল কাহিনী, নাটকীয় বিষয়, টাইপ চরিত্র ইত্যাদি নানা প্রাক্তন নাটকীয় সংস্কারকে বর্জন করলো 'রাজা'। একটি জাতক কাহিনীকে ভিত্তি করে রচিত 'রাজা'।
'রাজা'র পর রবীন্দ্রনাথ ১৯১২ সালে দুটি নাটক লেখেন - 'অচলায়তন' এবং 'ডাকঘর'। প্রথমটির দার্শনিকতা 'রাজা'-র তুলনাই কম ভারী। দ্বন্দ্বের চিত্র বেশি। নাটকটি ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আক্রমণ বলে বিবেচিত। এই নাটক সমাজের একাংশকে উত্তেজিত করে এবং কলকাতার কোনো থিয়েটারেই অভিনীত হয়নি। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ 'গীতাঞ্জলি' এবং 'গীতালি' লিখেছিলেন যার জন্য তাঁকে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। গঠনে ও ভঙ্গিতে অনায়াস সারল্য এবং আবেগের তীব্রতায় ডাকঘর প্রতীকী নাটকের সরবোচ্চ স্তর স্পর্শ করেছে।
প্রতীকী নাটকের চূড়ান্ত স্তর হল ১৯২৪ সালের রচনা 'রক্তকবরী'। এই নাটকের চিত্র অন্য নাটকের চেয়ে জটিল। এর চিত্রকল্পে এবং গঠনে এমন এক ঐশ্বর্য আছে যা আগের নাটক গুলিতে পাওয়া যায় না। এটি রবীন্দ্রনাথের প্রতীকী নাটক গুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। আরেকটি প্রতীকী নাটক হল 'মুক্তধারা'। ইউরোপ এবং আমেরিকায় ব্যাপক পরিভ্রমান্তে দেশে ফিরে তিনি এই নাটক দুটি লিখেছিলেন। ধনবাদী, আগ্রাসী সভ্যতার নীতিহীনতা এবং যন্ত্র অধিষ্ঠিত সমাজ জীবনে মানুষের অবমূল্যায়ন তাকে ব্যাথিত ও ক্ষুদ্ধ করেছিল। মুক্তধারা এবং রক্তকরবীতে সভ্যতার এই অমঙ্গলের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা করেছেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন