সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজনৈতিক অবস্থা | Political Situation in the Later Vedic Period

 পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজনৈতিক অবস্থা 

পরবর্তী বৈদিক যুগে স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজ ব্যবস্থার পত্তন ঘটলে সামাজিক উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হতে থাকে। এই উদবৃত্ত উৎপাদনের উপর ভর করে পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ক্রমশ জটিল হতে থাকে। শাসকের ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ থেকে জানা যায় দেবাসুরের সংগ্রামে দেবতাদের পরাজয়ের পর দেবতারা রাজার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁরা ইন্দ্রকে রাজা নির্বাচিত করলেন। ঐতিহাসিক বেণীপ্রসাদের মতে নেতৃত্ব দেবার উদ্দেশ্য থেকে রাজার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হল। কিন্তু রাজার ক্ষমতা ক্রমশ নিরঙ্কুশ হল। সম্রাট, একরাট প্রভৃতি অধিক ক্ষমতাধর উপাধিগুলি তিনি ধারণ করলেন। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে অশ্বমেধ, রাজপেয়, রাজসূয় প্রভৃতি যজ্ঞদির উল্লেখ রাজকীয় ক্ষমতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। তিনি ক্ষেত্রের অধিকারী, তাই ক্ষত্রিয়। তিনি বিশ এর মানুষকে ভক্ষণ করেন। তিনি সমগ্র পৃথিবী ও যাবতীয় প্রাণীর প্রভু- একথা সাহিত্যে উল্লেখিত। দেখা যায় বৈদিক যজ্ঞগুলি করে রাজা দেবত্বপ্রাপ্ত হচ্ছেন অর্থাৎ রাজার দৈব অধিকার দাবি করা হচ্ছে। তার নিয়োগ ক্রমশ বংশানুক্রমিক হয়ে যাচ্ছে।

প্রশাসনিক জটিলতাও ক্রমশ বৃদ্ধি পেল। শাসককে সহায়তা করেছেন যারা পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে তারা রত্নিন নামে পরিচিত। এরা হলেন সেনানী অর্থাৎ যোদ্ধা বাহিনীর পরিচালক, ভাগদুখ অর্থাৎ যিনি রাজকীয় অংশ ভাগ করে দেন এবং অক্ষবাপ অর্থাৎ যার হাতে রাজকীয় পাশা থাকে। অনেকেই মনে করেন এই রত্নিন শাসকের ক্ষমতার রাস কিছুটা টেনে ধরত আর পুরোহিতরা যারা বিভিন্ন যজ্ঞ করতেন শাসকের জন্য তারাও সম্ভবত শাসকের ক্ষমতার সংকোচন ঘটাতেন।

শাসকের ক্ষমতা যে ক্রমশ নিরঙ্কুশ হয়ে উঠল না তার জন্য সভা ও সমিতি নামে দুটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ঋকবেদের বিদথ পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে অন্তর্হিত। একসময় মনে করা হত সভা ও সমিতি একটিই প্রতিষ্ঠান, কিন্তু অথর্ব বেদে সভা ও সমিতিকে প্রজাপতির দুই কন্যা বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান দুটি যে পৃথক তাতে আর কোন সন্দেহ নেই। কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল তৎকালীন জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগের বসে গণতন্ত্রের ভারতীয় উৎস দেখাতে গিয়ে সভাকে উচ্চকক্ষ ও সমিতিকে নিম্নকক্ষ দেখাতে চেয়েছিলেন। এই মত গ্রহনযোগ্য নয়। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে সভাতে সম্পত্তিবানরা যোগদান করতেন, যেখানে পাশা খেলার মতো বিনোদন চলত। কিন্তু সমিতির রাজনৈতিক চরিত্র যথার্থ। সমিতিতে কৌমের সকল সদস্য এবং দলপতি শাসক যোগ দিতেন। যুদ্ধ কিংবা কৌম সংক্রান্ত নানা বিষয়, এমন কি নির্বাসিত দলপতি শাসককে ফিরিয়ে নিয়ে আসার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ও সেখানে আলোচিত হত।

একটি সমাজে প্রশাসক গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিয়মিত কর সংগ্রহ ছাড়া সম্ভব নয়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে শাসকে বলিহৃত বলা হয়েছে অর্থাৎ যিনি বলি বা কর সংগ্রহ করেন। এই যুগে বলি ছিল নিয়মিত আদায়, তবে তার পরিমাণ কি ছিল তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। যাইহোক পরবর্তী বৈদিক যুগে কৌম ভিত্তিক রাজনৈতিক জীবন ক্রমশ যে রাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হচ্ছিল তা স্পষ্ট।

Political Situation in the Later Vedic Period

In the Later Vedic Period, the political situation becomes gradually complex. With the establishment of a stable agrarian society in the Later Vedic era, social development continues. The evolution of this development gradually contributes to the complexity of the political system in the later Vedic era. The power of rulers continues to increase gradually. From the Aitareya Brahmana, it is known that after the defeat of the Devas in their battle with the Asuras, the Devas felt the need for a king. They chose Indra as their king. According to these accounts, historians like Beni Prasad opined that Devas felt the necessity of King due to the purpose of leadership. However, the power of the king gradually becomes unchecked. Samrat, Ekrat, and other powerful titles were assumed by them. References in subsequent Vedic literature to rituals like Ashwamedha, Rajasuya, etc., hint at the increase of political power. They were the rulers of the land, hence Kshatriyas. They consumed the wealth of the people. They are mentioned as the lords of the entire earth and all living beings in contemporary literature. It is observed that through Vedic sacrifices, kings were becoming divine, meaning they were claiming divine rights of kingship. Their appointment is gradually becoming hereditary.

Administrative complexity also gradually increased. Those who assisted the ruler were known as Ratnins in the subsequent Vedic literature. They included Senanis, the commanders of the army; Bhagadugha, those who divided the royal portion; and Akshabapa, those who held the royal pasha. Many believe that these Ratnins somewhat restrained the ruler's power, while the priests who performed various sacrifices possibly contributed to the contraction of the ruler's power.

For those, rulers' power did not become unchecked, the roles of assemblies and councils, named Sabha and Samiti, became significant. The Vidathas of Rigveda are incorporated in subsequent Vedic literature. It was once thought that Sabha and Samiti were the same institution, but in Atharva Veda, Sabha and Samiti are referred to as the two daughters of Prajapati, indicating that they were separate entities. Kashi Prasad Jayaswal, in his contemporary nationalist fervor, tried to show the Indian origin of democracy by portraying Sabha as the higher class and Samiti as the lower class. This theory is not widely accepted. Modern research indicates that while wealthy persons participated in the Sabha, where entertainment like gambling took place, the political character of the Samiti was genuine. In the Samiti, all community members and the ruler participated. Various issues related to war or the community, even the important political issue of bringing back an exiled feudal lord ruler, were discussed there.

In a society, the presence of the ruling group and the military force regularly collecting tribute is essential. In subsequent Vedic literature, the ruler is described as Ballihrit, meaning one who speaks or acts and collects. In this era, the ruler was supposed to regularly collect tribute, but the exact amount is not specified. However, it is evident that in the subsequent Vedic era, as the society gradually moved towards a clan-based political life, the path of monarchy was becoming prominent.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...