উপনিবেশিক ভারতের খেলা ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্ক
খেলাধুলো আমাদের দৈনন্দিন সামাজিক ও সংস্কৃতিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু সংস্কৃতি চর্চায় বা ইতিহাস চিন্তায় খেলাধুলো কোনদিনও গভীর ও গৌরবের স্থান পায়নি। উপনিবেশিক ও উত্তর ঔপনিবেশিক দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতে ও খেলা বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকেছে। ১৯ ও ২০ শতকের ভারতের খেলার সামাজিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা, দেশভাগ, শরণার্থী সমস্যা, কূটনীতি, বাণিজ্যিকতা বিভিন্ন খেলার বিবর্তনের ইতিহাসে প্রতিফলিত আছে।
ভারতবর্ষে খেলাধুলার সামাজিক ইতিহাস আশ্রয়ী গবেষনার ঐতিহ্য বেশি দিনের নয়। যেখানে পশ্চিমী বিশ্বে অতীত ও বর্তমানের জনজীবনে খেলার গুরুত্ব গত ৩ দশকে প্রথাগত সমাজবিজ্ঞান চর্চার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেখানে এদেশে ভারতীয় সমাজে খেলা ভূমিকা নিয়ে গবেষণা এ যাবৎ খুবই সীমিত। আর যেটুকু বা লেখালিখি হয়েছে বা গবেষণা হয়েছে তা মূলত ক্রিকেট ও ফুটবলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।
পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি বা চরিত্র, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক আন্দোলনের সীমারেখায় যে শুধু সীমাবদ্ধ ছিল না - এ তথ্য আজও ঐতিহাসিক মহলে সর্বজন স্বীকৃত। ১৯ শতক জুড়ে এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধে উপনিবেশ তথা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সমাজ- সংস্কৃতির বিভিন্ন উপকরণকে আশ্রয় করে প্রতিভাত হয়েছিল। ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, পরিবার, যাত্রা, নাটক, ক্রিয়া, চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিবিধ অঙ্গনে জাতীয় চেতনার পূণ্যপ্রকাশ এ যুগে হয়েছিল। জাতীয়তাবাদের একটি বিশেষ রূপ প্রতিফলিত হয় ভারতে তথা বাংলাদেশের ফুটবল চর্চার মধ্যে।
ইংরেজরা ভারতীয়দের মধ্যে ফুটবল খেলার প্রসারে স্কুল কলেজ স্তরে উৎসাহ দিয়েছিল। তার একটি অন্যতম কারণ ছিল বাঙালি যুবক সমাজকে এ ধরনের বিনোদনমূলক ক্রীড়ায় নিমগ্ন রেখে যেকোনো রকম জাতীয় আন্দোলন বা রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। ইংরেজরা স্বপ্নেও ভাবিনি যে একদিন এইসব মনেপ্রাণে ইংরেজদের দীক্ষিতের দলই ইংরেজদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজভাষাকে রাজবিদ্রোহ প্রচারে ব্যবহার করবে।
ফুটবলে মোহনবাগানকে কেন্দ্র করে করেই এই ইংরেজ বিদ্বেষী জাতীয়তাবাদ প্রবল আকার ধারণ করে। স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মোহনবাগান কে কেন্দ্র করে খেলাটা বাঙ্গালীদের কাছে আহত আত্মমর্যাদা, পৌরুশ আর জাতীয়তাবাদের প্রকাশের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ১৯১১ সালে গোরা দলকে হারিয়ে মোহনবাগানের শিল্ড বিজয় এই বার্তা বয়ে এনেছিল। মোহন বাগানের এই শিল্ড জয় কিভাবে সমস্ত বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের এক প্লাবন এনেছিল আর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিককালে পর্যাপ্ত গবেষণা হয়েছে। টনি ম্যাসন বা পরডিমিওর মতো ইউরোপীয় লেখকরা শিল্ড বিজয়ের জাতীয়তাবাদী ও জাতিগত তাৎপর্ীল মূলত "Games Ethic" এর সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের প্রেক্ষিতে উপস্থাপনা করেন এবং একটি ভারতীয় দলের এই আপাত সাফল্যের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে ইংরেজদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের চূড়ান্ত সার্থকতা দেখতে পান। অন্যদিকে সৌমেন মিত্র বা বোরিয়া মজুমদার মত ভারতীয় গবেষকরা এই জয়কে শারীরিক শক্তি তথা পৌরুষ প্রকাশের স্বদেশী ধারার প্রেক্ষাপটে এক দেশীয় জাতীয়তাবাদী প্রতিবাদ রূপে দেখেছেন। তাদের মতে শিল্ড জয় শুধু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে নয় সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে যথেষ্ট ছাপ ফেলেছিল।
বস্তুতপক্ষে পরাধীন ভারতের ফুটবল খেলা বাঙালি তথা ভারতীয়দের সামনে এমন এক সাংস্কৃতিক অস্ত্র তুলে ধরেছিল, যার মাধ্যমে একই নিয়ম নীতির আঁধারে ইংরেজকে পরাজিত করা যায়। বাঙালির এই ঐক্যমূলক ফুটবলীয় সত্তার মধ্যে জাতপাত, ধর্ম সম্প্রদায়, শ্রেণীবিভেদের বিরুদ্ধে একজাতীয় চেতনার ধারক ও বাহক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল।
স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে বাঙালি সমাজের একটা অংশ শিক্ষিত বুদ্ধিদীপ্ত ও সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আন্দোলনে যোগ দিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। স্বাভাবতই ফুটবল মাঠে ইংরেজকে হারানোর মধ্যে তারা পেতেন যেন স্বাধীনতা সংগ্রামে জয় লাভের এক অনাস্বাদিত মানসিক তৃপ্তি।
তবে এ কথা মনে রাখা বাঞ্ছনীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পট পরিবর্তনের এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির ঐক্যমূলক ক্রিড়াসত্তাও ক্রমশ সাম্প্রদায়িক এবং অন্যান্য সামাজিক রেখায় বিশিষ্ট বা বিভাজিত হয়েছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন