স্ত্রী শিক্ষার অগ্রগতি
ঐতিহ্যিক দিক থেকে শিক্ষার অর্থ ছিল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠ। হিন্দুদের মধ্যে পুরোহিত শ্রেনীর অন্তর্গত ব্রাহ্মণরা ধর্মশাস্ত্রের সকল শাখা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করত। অপরদিকে দুই বর্ণ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যগন ততটা কঠোরভাবে পাট গ্রহণ না করলেও ব্যবহারিক দক্ষতার জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতেন। শূদ্র এবং নারী ধর্ম শাস্ত্র পাঠ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। উচ্চ শ্রেণীর পরিবারে কিছু নারী পৌরাণিক সাহিত্য পাঠ করতে শেখেন। মুসলিম নারীরা কোরান শিক্ষা করবেন আশা করা হত, কিন্তু উচ্চ শ্রেণীর মুসলিম পরিবার তাদের কন্যা সন্তানদের বিদ্যালয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। ফলে ধর্ম সম্বন্ধে তারা যে শিক্ষা পেত তার গৃহ বা পরিবারে কাছ থেকে অথবা গৃহ শিক্ষকের কাছ থেকে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা ছিল একেবারেই কম।
স্ত্রী শিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল খ্রিস্টান মিশনারিরা। তবে তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিতা ভারতীয় মহিলাদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার ব্যাপারে বেশি মনোনিবেশ করে। মিস কুককে চার্চ মিশনারি সোসাইটি সম্ভ্রান্ত বংশের হিন্দু বালিকাদের জন্য ৩০টি বিদ্যালয় খোলার দায়িত্ব দেন। একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বালিকা বিদ্যালয় ছিল হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় বা বেথুন স্কুল, যা ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিদ্যালয়টি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ এবং শিক্ষার মাধ্যম ছিল বাংলা। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে এই স্কুল বেথুন কলেজে পরিণত হয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পায়। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কাদম্বিনী বসু ও চন্দ্রমুখী বসু বেথুন কলেজ থেকে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন এবং তাঁরাই ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট ছিলেন।
বাংলার সমাজসংস্কার মূলক সংস্থা হিসেবে ব্রহ্মসমাজের সভ্যগণ স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে নেতৃত্ব দেন। কেশব চন্দ্র সেন ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে স্ত্রী শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে বক্তৃতা দেন। পরবর্তী বছর পুরুষদের এক সমাজ গঠন করেন, যারা নারী সমাজের জন্য সংস্কার মূলক কাজকর্মকে সমর্থন করেছিল।
মাদ্রাজে থিওসফিক্যাল সোসাইটিও স্ত্রী শিক্ষাকে উৎসাহ দান করে। এর নেত্রী অ্যানি বেসান্ত বলেন প্রাচীন যুগে হিন্দু নারীরা শিক্ষা লাভ করতেন এবং সমাজের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারতেন তিনি সেই স্বর্ণযুগের ফিরে যাওয়ার কথা বলেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে বেসান্ত যখন প্রথম ভারতে বক্তৃতা দেন তিনি ভারতের অতীতের গৌরবের কথা এবং পুনরুদ্ধারের কথা এবং পরবর্তী সমস্যার কথা আলোকপাত করেন 1938 খ্রিস্টাব্দে নাগাদ তিনি স্ত্রী শিক্ষার উপর" Indian ladies Magazine" একটি প্রবন্ধ রচনা করেন সেখানে তিনি বলেন স্ত্রী শিক্ষার প্রসার ব্যতীত ভারতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে হান্টার কমিশন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ক্ষেত্রে প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় ও শিক্ষক শিখন বিদ্যালয় প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। নদীর উচ্চশিক্ষা এবং সহশিক্ষা তখনও ছিল বিতর্কিত একটি বিষয় ।কারণ ৯৮ শতাংশ বালিকাই বিদ্যালয়ে যেত না। ১৮৮১ থেকে ৮২ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে মাত্র ৬ জন ছাত্রী ছিল শতাব্দী শেষে সংখ্যাটি দ্বারায় ২৬৪ জন।
হান্টার কমিশন পরবর্তী যুগ ও শতাব্দীর শেষআর্ধে স্ত্রী শিক্ষার বিষয়ে তিনজন পথিকৃৎ শিক্ষাবিদের কথা বলা হয় এরা হলেন মুম্বাইয়ের পুনার সারদা সদন এর প্রতিষ্ঠাতা এ রমাবাঈ সরস্বতী ,কলকাতা মহাকালীর পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা মাতাজি গোপস্বামী, এবং পুনায় বিধবা দের জন্য বিদ্যালয় স্থাপনকারী ডি .কে.কার্ভে। সমসাময়িক ধারণা অনুযায়ী এইগুলো ছিল ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যালয় না।
পন্ডিতা রমাবাই সরস্বতী ছিলেন স্ত্রী শিক্ষার একজন পথিকৃৎ এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সমর্থক। তিনি বোম্বাই এ বিধবাদের জন্য সারদা সদন নামক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এটি ছিল সাম্প্রদায়িক বিদ্যালয় যেখানে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সকল প্রকার জাতিগত রীতিনীতি অত্যন্ত সতর্কের সঙ্গে মেনে চলা হতো গোড়া হিন্দু হিসেবে পরিচিত এই সমিতিতে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ৮০ জন মহিলাকে প্রশিক্ষণ দেয় যারা শিক্ষকতা ও সেবিকার কাজের মাধ্যমে নিজেদের জীবিকা নির্বাহীনে সক্ষম হন। রমাবাঈ তার প্রতিষ্ঠানের বাসিন্দাদের খ্রিস্ট ধর্মের দীক্ষিত হতে উৎসাহিত করেন খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিশেষ মতবাদ পুষ্ট। রমাবাই জাতপাত কে হিন্দি সমাজের বৃহৎ ত্রুটি বলে মনে করেন। তিনি একটি পাঠক্রমের ব্যবস্থা করেন যার মধ্যে মুদ্রণ কারুশিল্প পোশাক তৈরি স্থাপত্য শিল্প কৃষি কাজ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
মহাকালী পাঠশালা ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে মাতাজি তপস্বিনী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় এটি স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে প্রকৃত ভারতীয় প্রচেষ্টা হিসেবে কাজ করে ।এই বিদ্যালয়টি কোন বিদেশী সাহায্য পায়নি বা কোন বিদেশী শিক্ষক নিয়োগ করেনি, এদের লক্ষ্য ছিল কঠোর জাতীয় ভাবধারায় বালিকাদের শিক্ষিত করে তোলা যাতে তারা হিন্দু সমাজকে নব শক্তি দান করতে পারে।
১৮৯০ দশকে কেশব কার্ভে পুনায় বেশ কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ।এই বিদ্যালয়ের পাঠক্রম ছিল অল্প বয়সী বিধবাদের আত্মনির্ভর যোগ্য গড়ে তোলা ।তিনি বিশ্বাস করতেন বিধবা দের শিক্ষার প্রয়োজন আছে। যা তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করে তুলবে। এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা করতে সক্ষম করে তুলবে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বালিকা বিদ্যালয় গুলিতে ছাত্রী সংখ্যা নাটকীয় বৃদ্ধি পায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে দেশের প্রায় সকল অংশের মহিলাদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে ।বিদ্যালয় স্তরে ছাত্রী সংখ্যা ৩ গুণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থলে ৫ গুণ বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে বেগম রোকেয়া এবং সিস্টার শুভলক্ষ্মী নাম পথিকৃৎ। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও এটি কোন মুসলমান মহিলাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম বিদ্যালয় ছিল না কিন্তু তার সুশৃঙ্খল এবং নিষ্ঠা তাকে পথিকৃৎ এর ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা করেছিল। বেগম রোকে য়া নারীর অপরাধ সমালোচনা করেছেন তিনি লিখেছেন যে এটি একটি ক্ষত নয় এটি একটি কার্বন মনোক্সাইডের মত নিঃশব্দ ঘাতক কুরআন বা শরিয়তে এই প্রথার বিশেষ ভিত্তি নেই।
সিস্টার শুভলক্ষ্মী মাদ্রাজে উচ্চ বর্ণের বিধবা যুবতীদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন তিনি সমাজের পরিত্যক্তা বিধবা দিকে মনোযোগ দেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষক শিক্ষণ প্রতিষ্ঠা হিসেবে The lady willingdon traning collage and practice School প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানে শুভ লক্ষ্মী শিক্ষা সম্পর্কে কিছু ধ্যান-ধারণা নাকি কার্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এই এই মহাবিদ্যালয় তিনটি কর্মপরিকল্পনা অনুসরণ করা হয় উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্য স্নাতকোত্ত শিক্ষণ অষ্টম শ্রেণিদের জন্য শিক্ষক শিক্ষণ এবং প্রাথমিকদের জন্য শিক্ষণ। তাছাড়াও ইংরেজির উপর জোর দেওয়া হয় হাতের কলমে কাজ শেখার জন্য বৃত্তিমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন