হিস্ট্রি ও ইতিহাসের পার্থক্য
সাধারণভাবে আমরা হিস্ট্রি ও ইতিহাসকে সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। তবে ইতিহাস ও হিস্ট্রির মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ইতি, হ, আস এই তিনটি পদের সমন্বয়ে ইতিহাস শব্দটি গঠিত। এর আক্ষরিক অর্থ 'এই রূপ ছিল'। ইতিহাস শব্দটির আভিধানিক অর্থ অতীতের সংগঠিত বাস্তব কাহিনী, প্রাচীন কাহিনী বা পুরাবৃত্ত।
History শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ 'Histor' শব্দ থেকে যার অর্থ জ্ঞান, এবং গ্রিক শব্দ হিস্টোরিয়া থেকে যার অর্থ
সযত্নে অনুসন্ধান করা। ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিক দিয়ে হিস্ট্রি শব্দের তাৎপর্য
ব্যাপকতর। ইতিহাস বলতে যে কোনো পুরাকাহিনীকে বোঝানো হয়, কিন্তু হিস্ট্রি হল অতীতের বিষয়ে
অনুসন্ধানলব্ধ জ্ঞান।
প্রাচীন ভারতের জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে ইতিহাস চর্চা হতো। কিন্তু এই ভারতীয় ধারণার ইতিহাস ও হিস্ট্রি এক নয়। প্রাচীন পালি ও তামিল ভাষায় বহু ইতিহাস-সাহিত্য রচিত হয়েছিল। আখ্যান, ইতিবৃত্ত, বংশচরিত, পুরান এবং বিশেষত অতীতের রাজনৈতিক ঘটনাকে প্রাচীন ভারতীয়রা ইতিহাসের বিষয়বস্তু রূপে অন্তর্ভুক্ত করত। রূপকথা ধর্ম, গাথা , ইতিহাস কাব্য এইসবই ইতিহাস বলে গণ্য করা হতো। প্রকৃতপক্ষে যাকে ইতিহাস (History ) বলা হয় সে বিষয়ে ভারতীয়দের ইতিহাস বোধের অভাব ছিল। পুরাণ কাব্য রচয়িতাদের কাছে ইতিহাসের বিষয়বস্তু ছিল রাজনীতি কিংবা যুদ্ধবিগ্রহ। মানুষের জীবন ও ধারাবাহিক সভ্যতার বিবরণ সেখানে পাওয়া যায়নি। রাজাদের আলংকারিক জীবনচরিত ইতিহাস রূপে গণ্য হয়েছে। হিস্ট্রি চর্চা ও রচনার নিয়ম রীতি এবং পরম্পরা ইতিহাসের ক্ষেত্রে স্থান পায়নি।
হিস্ট্রির ক্ষেত্রে ঘটনার কালানুক্রম অনুযায়ী বিবরণ ও তথ্য লিপিবদ্ধকরণ, বিশ্লেষণ ইতিহাস্কারের দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত হয়ে যথার্থ হিস্ট্রি রচিত হয়। হিস্ট্রি কেবলমাত্র অতীত বিবরণ নয়, অতীতের আলোকে বর্তমানকে দেখা। What is History শীর্ষক বক্তৃতায় ঐতিহাসিক ই.এইচ.কার বলেন ইতিহাস হল বর্তমান ঐতিহাসিক ও অতীতের মধ্যেকার পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার নিরন্তর প্রক্রিয়া। নির্বাচন, বিচার বিশ্লেষন, কার্যকারণ আবিষ্কার, এবং গ্রন্থনের বিভিন্ন ধাপের মধ্যে দিয়ে হিস্ট্রি অগ্রসর হয় এবং সত্যে উপনীত হবার চেষ্টা করে। ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই সব দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয় না।
তবে ধর্মীয় সাহিত্য কি একদমই ইতিহাসচেতনা বিহীন ছিল ? এ বিষয়ে প্রথম প্রশ্ন তোলেন উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল। পরবর্তীকালে এই প্রশ্নকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান রোমিলা থাপার। রোমিলা থাপার বলেন যে প্রাচীন ধর্মীয় সাহিত্যগুলো পদ্ধতিগতভাবে হিস্ট্রি পদবাচ্য না হলেও, সেগুলির মধ্যে অতীত বিবরণ সংরক্ষণের প্রচেষ্টা রয়েছে। অতীতকে কার্যকারণ সম্পর্কযুক্ত কালানুক্রমে সাজানো, এবং সমসাময়িক সমাজের কাছে অতীতের তাৎপর্য নিয়ে সচেতনতা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য যদি থাকে, সেগুলিকে 'ঐতিহাসিক পরম্পরা' বলা যায়। প্রাচীন ভারতের প্রথম দিকের ঐতিহাসিক পরম্পরা গুলি ছিল ধর্মীয় সাহিত্যে অন্তর্নিহিত অর্থাৎ 'এম্বেডেড হিস্ট্রি'।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন