আদি মধ্যযুগে দক্ষিণ ভারতের বণিক সংঘ
‘ গিল্ড’ বলতে আমরা সাধারণত বুঝি এমন এক বাণিজ্যিক সংগঠন যা কতকগুলি নিয়মের দ্বারা পরিচালিত, যা সব সদস্য মেনে চলে। আদি মধ্যযুগে দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্য সংগঠনগুলি এই শর্ত পূরণ করে না, যদিও ‘বার্নাজু ধর্ম’ নামক আচরণের এক ধরনের আদর্শ তাদের সামনে ছিল, যা গিল্ডের নিয়মাবলিকে মনে করায়। ড. আর. চম্পকলক্ষ্মী তাই এইসব প্রতিষ্ঠানকে ‘গিল্ড’ না বলে বাণিজ্য সংস্থা বা বাণিজ্যিক সমবায় বলার পক্ষপাতী। কার্যপরিধি অনুসারে তাদের মােটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
১। নগরম স্থানীয় বাণিজ্য সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করতে। সব বিপণন কেন্দ্রেই এদের অস্তিত্ব ছিল। এখানে ভ্রাম্যমাণ বণিকদের সঙ্গে স্থানীয় বণিকরা পণ্য বিনিময় করত। অন্তত চতুর্দশ শতক পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতে, বিশেষত তামিলনাড়ুতে এদের অস্তিত্ব ছিল। দক্ষিণ ভারতে মুদ্রা কমই ব্যবহৃত হত। পণ্য বিনিময় ব্যবস্থা (barter system) অধিক প্রচলিত ছিল।কতকগুলি বিশেষ পণ্যের ক্ষেত্রে যেমন বস্ত্র বা তেল— নগরমের পক্ষ থেকে উপ-নগরমকে কেনাবেচার দায়িত্ব দেওয়া হত। সামুদ্রিক বাণিজ্যে নিযুক্ত বণিকদের ক্ষেত্রে আমরা ‘পারগলগরম’ শব্দের উল্লেখও পেয়েছি।
২। মণিগ্রাম আঞ্চলিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠন। দক্ষিণ ভারতের অনেক প্রাচীন লিপি এবং শ্যামদেশে প্রাপ্ত পল্লবরাজ তৃতীয় নন্দীবর্মনের একটি লিপিতে বণিক-গ্রামম’ শব্দটি পাওয়া যায়। মণিগ্রামম’ মনে হয় তার অপভ্রংশ। দূরপাল্লার বাণিজ্যেও যে এই সংগঠন অংশগ্রহণ করত, তার প্রমাণ শ্যামদেশের পূর্বোক্ত লিপিতেই মেলে। সেখানে একটি বিষ্ণু মন্দির ও পুষ্করিণী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানের ওপর দেওয়া হয়েছে বলে লেখা আছে।
৩। আইনডুভর মধ্যযুগে দক্ষিণ ভারতে ভ্রাম্যমাণ বণিকদের বৃহত্তম সংস্থা। অষ্টম শতকে আইহােলের (পুরাতন নাম আয়তলেপুরা) স্থানীয় বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সেখানকার ব্রাহ্মণ বা মহাজনদের মিলিত সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠানটি জন্ম নেয়। এই কারণে আয়তলেপুরার ৫০০ স্বামী নামেও প্রতিষ্ঠানটি খ্যাত। ৫০০ অবশ্য এখানে সদস্য সংখ্যা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। কালক্রমে এর সদস্যসংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যায়। আইহােল বরাবর এর প্রধান কেন্দ্র ছিল না। শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠানটির যে সঙ্ঘবদ্ধ রূপ ছিল, পরবর্তীকালে তা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তবু প্রতিষ্ঠানটির নাম বদল হয়নি।
উপরােক্ত তিন ধরনের বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আরও নানা ধরনের বাণিজ্য সংস্থার নাম আমরা একালে পাই, যেমন— নানাদেশি, উভয়-নানাদেশি, বনজিগ ইত্যাদি। কিন্তু এদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করা কঠিন। নগরত্তর’ নামে সকল বাণিজ্য সংস্থাকে বােঝানাে হত। আইনণুডুভর সংস্থার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। একমাত্র তারাই গুদামসহ নগর (এরিবীরপত্তন) নির্মাণ করে তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভাড়াটে সৈন্য, হস্তি ও অশ্ববাহিনী নিয়ােগ করে।
চোল রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আইনণুড়ুভরের বিস্তৃতি ঘটে। চোল রাজা প্রথম রাজরাজ (৯৮৫-১০১৪) বঙ্গোপসাগরকে চোল হ্রদে পরিণত করেছিলেন। তার বেঙ্গি জয়ের পরিণামে ৫০০ স্বামীর প্রতিষ্ঠানের কার্যপরিধি উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। প্রথম কুললাতুঙ্গের নামানুসারে বিশাখাপত্তনম বন্দরের নাম হয় কুলােতুঙ্গ-চোলান পট্টিনাম। বাণিজ্যিক শ্রীবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রথম কুলােতুঙ্গ পূরিবহন শুল্ক তুলে দেন এবং শ্রীবিজয় ও চিনের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রথম রাজরাজ এবং প্রথম কুলােতুঙ্গ নেগাপত্তম বন্দরের উৎকর্ষ সাধনে সচেষ্ট ছিলেন। চোল সাম্রাজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দশম শতক থেকে কাবেরি নদীর দুইপাশে আইনণুড়ুভরের প্রভাব রীতিমতাে চোখে পড়ে। চোল এবং পাণ্ড্য রাজ্যের মধ্যে প্রত্যক্ষ যােগাযােগের পথে আইনগুড়ুভর তামিল দেশে প্রথম পুদুকোট্টাই শহরে পৌছােয় নবম শতকের শেষে। তখন থেকে চোদ্দ শতক পর্যন্ত পুদুকোট্টাই এবং রামনাথপুরম অঞ্চলে তাদের বিভিন্ন কাজের একটানা নিদর্শন মেলে। তামিল বণিকরা আগের থেকে বেশিবার অন্ধ্রপ্রদেশে যান। সালেম, এরােড এবং কোয়েম্বাটুরে তাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তামিলনাড়ুর তিরুনেলিভেলি জেলার সঙ্গে দক্ষিণ কেরলের বাণিজ্যিক সংযােগ ছিল। যাত্রাপথগুলির দু-ধারে সুরক্ষিত নগরী গড়ে ওঠে। সেখানে বিদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে স্থানীয় নগরমের বাণিজ্য অভূতপূর্ব মাত্রা ছোঁয়। তাঞ্জোর, নেগাপত্তন, কাঞ্চী, রামনাথপুরমের মতাে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নগরমের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রান্তিক এলাকা এবং সালেম, এরােড ও কোয়েম্বাটুরের মতাে উল্লেখযােগ্য বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলিতে আইনগুড়ুভরের প্রভাব কেন্দ্রীভূত ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, অষ্টম-নবম শতকে ভারতের পশ্চিম উপকূলে, বিশেষত কেরলে ‘অঞ্জুবন্নম’ নামেএকটি ইহুদি বণিক সংস্থা বাণিজ্যে উদ্যোগী হয়েছিল। পরে অবশ্য মুসলমান আরব বণিকরা এর সঙ্গে যুক্ত হয়। একাদশ শতক থেকে তামিল বণিকরা কর্নাটকেও পৌছেছিল।
Thank you sir.
উত্তরমুছুন