আজীবিক ধর্ম
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে বহু প্রতিবাদী ধর্মমতের উদ্ভব হয়। এগুলির সংখ্যা ছিল আনুমানিক ষাট বা তার বেশি। এদের মধ্যে আজীবিক ধর্ম বেশি জনপ্রিয় ছিল। অশোকের শিলালিপি থেকে এ কথা জানা যায়। গুপ্ত যুগেও আজীবিকদের গুহা বা গুম্ফার কথা জানা যায়। আজীবিক ধর্মের প্রবক্তা ছিলেন গোশাল মঙ্খলিপুত্ত। তিনি জৈন ধর্মের প্রবর্তক বর্তমান মহাবীরের সমসাময়িক ছিলেন। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর অল্পকাল আগে সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪ অব্দে তার মৃত্যু হয়েছিল। অবশ্য উপকথা অনুসারে তিনি আরও আগের লোক ছিলেন বলে কেউ কেউ মনে করেন। আজিবিকদের ধর্মীয় কোন গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। জৈন বা বৌদ্ধ রচনায় আজিবিকদের সম্পর্কে যে উল্লেখ আছে তা থেকে আমরা তাদের সম্পর্কে জানতে পারি।
আজীবিক ধর্মবিশ্বাসে নাস্তিক্যবাদের প্রভাব বিশেষভাবে দেখা যায়। যাগযজ্ঞ বা দেবদেবীর পূজার কোনো নিয়ম তারা মানতেন না। আজীবিকরা বিশ্বাস করতো যে মানুষের কর্ম অখন্ডনীয়। এর হাত থেকে তার পরিত্রাণ নেই। নিয়তি মানুষের ভবিষ্যৎকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মানুষ বহু জন্ম সৎ ভাবে কাটাতে পারলে তবে নিয়তি বা কর্মফলের হাত থেকে নিস্তার পেতে পারে। ছোট-বড় পন্ডিত-মূর্খ নির্বিশেষে সকল মানুষকে ৮৪ লক্ষ বার জন্মগ্রহণ করতে হবে। একটি একটি করে সব কটি জীবনচক্র অতিক্রম করার পর অবশেষে জীবের দুঃখের অবসান হয়। এজন্য আজীবিকরা সন্ন্যাস ও তপস্যাকৃত জ্ঞানচর্চার উপর বিশেষ জোর দেয়।
ব্রাহ্মণ ও শূদ্র সকলেই কর্ম ফলের অধীন ।সুতরাং যাগ-যজ্ঞ করে কোন ফল নেই বলে আজীবিকরা বলত। আজীবিক ধর্মমত ছিল হতাশা থেকে জাত এবং নেতিবাচক। বৌদ্ধ ধর্মের মতো এতে ইতিবাচক দিক ছিল না। এতে অদৃষ্টবাদ ছিল বড়ই প্রবল। মানুষের কর্ম ও উদ্যোম এতে শিথিল হয়ে যেত। প্রথম দিকে আজিবিকদের প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল অবন্তী ও অঙ্গ'র মধ্যবর্তী অঞ্চল। মৌর্য সম্রাট অশোক ও দশরথ আজীবিকদের জন্য গুহা নির্মাণ করেন। অশোকের শিলালিপিতে আজীবিকদের প্রতি সৎ আচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আজিবিকরা জাতিভেদ ও শ্রেণীভেদের সমালোচনা করার ফলে নিম্ন বর্ণের লোকেদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। শূদ্র ও অস্পৃশ্যরা এই ধর্মের অনুগত হয়ে পড়ে। বৌদ্ধ ও জৈনদের তীব্র বিরোধিতার ফলে আজীবিক ধর্মের অবলুপ্তি ঘটে। নাস্তিক্যবাদী হলেও মানুষ কর্মফল ও জন্মান্তর সমস্যার সমাধানের পথ নির্দেশ না করায় এই ধর্মের জনপ্রিয়তা বৌদ্ধ ধর্মের তুলনায় কমে যায়। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে নবজাগ্রত বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে খুব সম্ভবত আজীবিক ধর্ম বিলীন হয়ে গিয়েছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন