সুফি আন্দোলন
খ্রীস্টীয় নবম–দশম শতকে ইসলাম ধর্মের মধ্যে একটি প্রগতিশীল আন্দোলনের সূত্রপাত হয় । এই আন্দোলন ‘সুফি আন্দোলন’ নামে পরিচিত। যারা সুফ বা পশমের বস্ত্র পরিধান করে তাদেরকেই সুফি বলা হয়। অর্থাৎ, সুফি কথাটির সঙ্গে ‘সাফা’ বা পবিত্রতা ও ‘সাফ’ বা অবস্থানের কোন সম্পর্ক নেই। সুফি মতাদর্শের উদ্ভবের পিছনে বিভিন্ন তত্ত্ব আছে । এই তত্ত্বগুলির মধ্যেও আবার স্ববিরোধ আছে। সুফি মতাদর্শের ওপর যোগ, উপনিষদ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল। সুলতানি সাম্রাজ্য স্থাপনের ফলে মুসলমানদের মধ্যে ভোগবিলাস ও ঐশ্বর্যের উন্মাদনা এবং তাদের নৈতিক অবক্ষয় ও অধঃপতন লক্ষ্য করে কয়েকজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান মর্মাহত হন। তাঁরা রাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে মনস্থ করেন । এঁদের অনেকেই ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের ভালবাসার বন্ধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এঁদের চিন্তাধারা গোঁড়া মুসলমানদের মনঃপূত হয় নি। তাঁরা সুফিদের ইসলাম বিরোধী বলে মনে করেন। ফলে সুফিরা ক্রমশ নিজেদের সরিয়ে নিয়ে নির্জনে ধর্মচর্চা করতে শুরু করেন। এঁরা একজন পীর বা শেখের অধীনে একটি ধর্ম সংগঠন গড়ে তোলেন। সংগঠনের সদস্যদের বলা হত ফকির বা দরবেশ। এঁরা ঈশ্বরে একাত্ম হয়ে নিভৃতে ধর্ম সাধনা করতেন।
সুফিরা মনে করতেন প্রেম ও ভক্তিই ঈশ্বরপ্রাপ্তির একমাত্র পথ । এর জন্য কোনো আচার-অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় অনুশাসন অপরিহার্য নয় । তাঁদের মতে, ত্যাগ ও বৈরাগ্যই হল মুক্তির একমাত্র পথ । আসক্তি থেকে আসে পাপ এবং পাপের অর্থ ক্লেশ । আত্মার শুদ্ধিকরণের জন্য সাধনা ও ঈশ্বরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপন করতে হবে । সর্বধর্মসমন্বয়, জীবে প্রেম ও সম্প্রীতি ছিল সুফিদের আদর্শ । ভারতবর্ষে সুফিরা ইসলামের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন । তাঁরা মনে করতেন, উলেমারা কোরানের ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা করছেন এবং ইসলামের গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাছেন । উলেমারাও সুফিদের উদার আদর্শবাদ সহ্য করতে পারতেন না । সুফিরা কিন্তু কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা চিন্তা করেন নি । বরং তাঁরা আশা করতেন একদিন সেইদিন আসবে, যেদিন আল্লাহ স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে ইসলামের আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন ।
বিভিন্ন সুফি সম্প্রদায় : ভারতবর্ষে সুফিদের প্রধানত তিনটি সম্প্রদায় প্রভাবশালী ছিল— দিল্লী ও দোয়াব অঞ্চলে চিশতি; সিন্ধু, পাঞ্জাব ও মুলতানে সোহরাবর্দি এবং বিহারে ফিরদৌসি ।
চিশতি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা মইনউদ্দিন চিশতি। তিনি মহম্মদ ঘুরির সময়ে মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে আসেন ও আজমিরে বসবাস করতেন চিশতি সাধকদের মধ্যে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার নাম সর্বপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত কবি আমির খসরু ও ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরানি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন।
সুরাবর্দি সম্প্রদায়ের সুফিরা পাঞ্জাব, মুলতান ও বাংলায় প্রভাবশালী ছিলেন । এই সম্প্রদায়ের সাধকদের মধ্যে শেখ শিহাবউদ্দিন সুরাবর্দি ও হামিদউদ্দিন নাগরি ছিলেন প্রধান । এই সম্প্রদায়ের সাধকেরা চিশতিদের মতো দারিদ্র ও কৃচ্ছ সাধনের জীবনাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না । সন্ন্যাসীর জীবনও এদের লক্ষ্য ছিল না । এঁরা রাষ্ট্রের অধীনে ধর্মীয় উচ্চপদ গ্রহণ করতেন ।
সুফিদের ধার্মিক ও অনাড়ম্বর জীবন, ঈশ্বর ভক্তি এবং নির্জনে সন্ন্যাসীর জীবনাদর্শ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল । ফলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মগত ব্যবধান কিছুটা লুপ্ত করতে এরা সক্ষম হয়েছিল । ইসলামের সাম্যের আদর্শে উলেমাদের চেয়ে সুফিরা বেশী জোর দিতেন বলে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ বিশেষত কৃষক ও কারিগরেরা সুফিদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল । কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁরা সমাজ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতেন বলে সমাজে তাঁদের কোন প্রভাব পড়েনি।
সুফি মতবাদ ও ভক্তিবাদের মধ্যে অনেক বিষয়েই মিল ছিল। যেমন-
(১) ঈশ্বরের প্রতি আত্মনিবেদন ও ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন উভয় আদর্শেই স্বীকৃত ছিল ।
(২) উভয় সম্প্রদায়ই বিশ্বাস করত যে গুরু অথবা পিরের সাহচর্য আত্মার মুক্তির পক্ষে বিশেষভাবে সহায়ক।
মিলের পাশাপাশি উভয় দর্শনের মধ্যে কিছু অমিলও ছিল । যেমন-
(১) সুফিদের ‘মিস্টিক’ বা মরমিয়া আদর্শ ভক্তিবাদী সাধকদের মধ্যে উৎসাহ সঞ্চার করতে পারে নি ।
(২) ভক্তিবাদী সাধকেরা নিজেদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন নি । বরং তারা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত সম্প্রদায়ের মধ্যেও তাঁদের আদর্শ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
মধ্য যুগীয় সমাজ ব্যবস্থা রূপায়ণের ক্ষেত্রে সুফিবাদ একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে কাজ করে ছিল৷ প্রথমত, সুফিবাদের সহজ সরল জীবনযাত্রা, চারিত্রিক মাধুর্য, গভীর নীতি বোধ সাধারন মানুষকে মুগ্ধ করে ছিল ৷ফলে জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের কাছে সুফিবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ধর্মীয় উন্মাদনা অনেকটাই প্রশমিত হয়৷ ইসলামের সামাজিক সাম্য ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের আদর্শ সুফিবাদিরা মেনে চলত৷ এই কারনে তথা কথিত নিম্ন বর্ণের হিন্দু ও অস্পৃশ্যদের কাছে সুফিবাদ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে৷ সুফিবাদের প্রভাবে ভারতে গোঁড়ামিভাব অনেকটাই কমে যায়৷ বহিঃদেশীয় ইসলাম ধর্ম ভারতীয় ধর্মে পরিনত হয়৷ দ্বিতীয়ত, চারিত্রিক শুদ্ধতায় বিশ্বাসী সুফিরা সুরা পান, জুয়া খেলা, কৃতদাস প্রথা ও বহু বিবাহের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ছিল৷ সুফি সাধকদের এই উচ্চনৈতিকতা বোধ মুসলিম যুবকদের মধ্যে প্রবল ভাবে জাগরণ সৃষ্টি করেছিল৷ তৃতীয়ত, হিন্দি ভাষা ও কাওয়ালি গানের বিকাশে সুফি সাধকদের দান অবিস্মরণীয় ৷ ইসলাম ধর্মে সংগীত অবহেলিত হলেও সুফি সাধকরা মনে করতেন যে, সংগীতে পরমাত্মার সঙ্গ লাভের আনন্দ পাওয়া যায়৷ এমনকি তারা কথোপকথনে হিন্দি ভাষার ব্যবহার ও হিন্দি ভাষায় কবিতা রচনার ফলে এই ভাষার ব্যপক সমৃদ্ধি হয়৷ চতুর্থত, কেবলমাত্র ধর্মাচরণের কেন্দ্র নয়, সুফিদের খানকাহ গুলি বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞান অন্বেষণের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়৷ অনেক খানকা শিক্ষা বিস্তার নিয়মিত ভাবে বিদ্যালয় পরিচালনা করত৷ পরিশেষে বলা যায়, সুফিবাদের প্রভাবে ইসলামের ভারতীয় করণ ঘটে ছিল৷ সুফি সন্তরা ভারতকে তাঁদের স্বদেশ এবং ভারতবাসীকে তাঁদের স্বজন বলে মনে করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে৷ যা ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন সুদৃঢ় করণে সহায়ক হয়ে ছিল৷
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনThank 😊you sir.
উত্তরমুছুনThank you🙏 sir.
উত্তরমুছুন