সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আদি মধ্য যুগে রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রকৃতি | Early Medieval Indian State

 আদি মধ্য যুগে রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রকৃতি

আদি মধ্য যুগে রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রকৃতি নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। বিশ শতকের গোড়ার দিকের ঐতিহাসিকগন যেখানে কেন্দ্রিভূত রাষ্ট্রের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করে ছিলেন সেখানে ঐ শতকের মাঝামাঝি সময় বেশ কিছু ঐতিহাসিক সামান্ততন্ত্রের তত্ত্ব খাড়া করেছেন। আবার সত্তরের দশকে আরও একটি নতুন তত্ত্ব উঠে এসেছে, সেটি হল বিভাজিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার তত্ত্ব। কোনো পক্ষই তাদের মতামতের সমর্থনে অকাট্য প্রমান হাজির করতে পারিনি বলেই কোনো তত্ত্বই আজও সম্পূর্ণ গ্রহনযোগ্য হয়ে ওঠে নি। 
গুপ্ত শাসনের অবসানের পর উত্তর ভারতে একাধিক আঞ্চলিক রাজশক্তির বিকাশ ঘটেছিল। দক্ষিণ ভারতেও ছবিটা একই রকম ছিল। আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলির শাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে   A. S. Altekar, K. A. Nilkantha Sastri, R. K. Mukharjee প্রমুখ ঐতিহাসিক কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন। কিন্তু মার্কসবাদী ঐতিহাসিকগন মার্ক্সের 'এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি' তত্ত্বের দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রসমূহ কে নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ, স্বৈরাচারী শাসকের দ্বারা পরিচালিত, উদ্বৃত্ত শোষনকারী অথচ প্রজাকল্যানকামী রাষ্ট্র হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁরা নিজেরাই এই বক্তব্য থেকে সরে আসেন এবং সামন্ততন্ত্রের তত্ত্ব তুলে ধরেন।

ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্বের কথা প্রথম উল্লেখ করেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত D. D. Kosambi -র An Introduction to the Study of Indian History গ্রন্থের দুটি অধ্যায় Feudalism from Above এবং Feudalism from Bellow- এ আদিমধ্য যুগে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্বের বিষয়টি তুলে ধরেন।  ওই বছরই তিনি এই বিষয়ে আরও দুটি প্রবন্ধ On the Development of Feudalism in India এবং Origin of Feudalism in Kashmir প্রকাশ করেন। এর দু বছর পর রামশরন শর্মা তাঁর গ্রন্থ Indian Feudalism ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের উতপত্তি ও বিকাশ বিষয়ক তাঁর গবেষনা প্রকাশ করেন। শর্মার মতে গুপ্তযুগের শেষ দিক থেকে রাজা এবং ধনী ব্যক্তিগন ব্রাহ্মন ও মন্দিরগুলিকে যে নিষ্কর ভুসম্পত্তি দান করতেন সেগুলির উপর দানগ্রহীতা ক্রমশ শাসন, আইন ও বিচারের ক্ষমতা লাভ করতেন। রাজারা সেখানে হস্তক্ষেপ করতেন না। বাহ্মন দানগ্রহীতা ঐ জমি বা গ্রামের কৃষকদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে যেতেন। এইভাবে অগ্রাহার জমি গুলিতে সামন্ত ব্যবস্থা গড়ে উঠত। ভূমিকর আদায়ের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে  ভূস্বামীগন কৃষকদের প্রায় ভূমিদাসের পর্যায়ে নামিয়ে আনতেন। কৃষির উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে কারিগরি উৎপাদন, বাণিজ্য ও মুদ্রাব্যবস্থা অবহেলিত হয় এবং এর জন্য নগরায়ন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূমিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা এবং উদবৃত্ত সংগ্রহ ও ভোগ করার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাই ছিল ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের মুল কথা। 

রামশরণ শর্মার বক্তব্যের সমর্থনে ও বিপক্ষে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ব্যাপক চর্চা হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সরকার রামশরণ শর্মার যুক্তিকে খন্ডন করে বলেছেন যে ভারতের সমাজ বা রাষ্ট্রে সামন্ততন্ত্র খুঁজতে যাওয়া অসমীচীন; কেননা এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্য ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্বকে সমর্থন করেনা। একথা ঠিক যে পুরোহিত শ্রেণীকে নিষ্কর ভূসম্পত্তি দান করা হত। কিন্তু এই দান জমিগুলির বেশিরভাগই ছিল পতিত জমি। শর্মার আরো একজন সমালোচক হরবন্স মুখিয়া বলেছেন যে ইউরোপে সামন্ততন্তের বিকাশের ক্ষেত্রে যে সার্ফ বা ভূমিদাসের অস্তিত্ব ছিল ভারতের ক্ষেত্রে তা ছিল না। কারণ ভারতের উর্বর জমি কৃষকদের স্বনির্ভর করে রাখত। ব্যাপক সমালোচনার ফলে বেশ কিছুদিন রামশরন শর্মার ভারতীয় সামন্ততন্ত্র তত্ত্ব ধামাচাপা পড়ে গেছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালে বি. এন. এস. যাদব বেশ কয়েকটি প্রবন্ধে এবং Society and Culture in North India গ্রন্থে সামন্ততন্ত্রের সমর্থনে লেখালেখি শুরু করেন. ফলে বিষয়টি আবার চর্চার মধ্যে আসে. কিন্তু এদের সকলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় Trade and Urban Centres in Early Medieval North India প্রবন্ধে ভারতের সামন্ততন্ত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে বাণিজ্য নগরের অবক্ষয়ের যুক্তিকে খন্ডন করেন।  সামন্ততন্ত্র তত্ত্ব বারবার সামালোচিত হলেও সমালোচকদের কেউই কোনও বিকল্প তত্ত্বের কাঠামো নির্মাণ করতে পারেননি।

সামন্ততন্ত্র ছাড়া আদি মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র বিষয়ক আরেকটি উল্লেখযোগ্য তাত্ত্বিক অবদান হল কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত বিভাজিত রাষ্ট্রের ধারণা, যাকে Segmentary State বলা হয়। ১৯৫৬ সালে A. W. Southall -এর আফ্রিকার প্রেক্ষিতে Alur Society: A Study in Progress and Types of Domination গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গবেষনার সাথে ভারতের ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু রাজপুত রাজ্যসমূহের ক্ষেত্রে R. G. Fox তাঁর Kin, Klan, Raja and Rule গ্রন্থে কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত বিভাজিত রাজ্যের ধারণা প্রকাশ করেন। এর পর দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রগুলির প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে Burton Stein Segmentary State  এর তত্ত্ব তুলে ধরেন। স্টেইনের মতে পল্লব, চোল এবং পরবর্তীকালে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাষ্ট্র ব্যবস্থা তিনটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে বিভাজিত ছিল। এই অঞ্চলগুলিকে কেন্দ্রীয় (Central), মধ্যবর্তী (Intermediate) এবং প্রত্যন্ত (Peripheral) হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলি প্রকৃতপক্ষে ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষি অঞ্চল, যেখানে কেন্দ্রীয় অঞ্চল সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারত না। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে রাজা ও তার সহযোগী গোষ্ঠী মধ্যবর্তী অঞ্চলকে নিয়ে সমগ্র সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। এই ব্যবস্থায় রাজার ক্ষমতাই ছিল সার্বভৌম। মধ্যবর্তী অঞ্চল এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করত।

স্টেইন ও তার সমর্থকদের বিভাজিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার ধারণা ভারতীয় ঐতিহাসিকদের কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য হয়নি। চোল রাষ্ট্র যদি বিভাজিত রাষ্ট্র হত তাহলে তাদের এত বড় কেন্দ্রীয় নৈসেনার অস্তিত্ব কিভাবে সম্ভব। আফ্রিকার সমাজ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য দক্ষিণ ভারতের প্রয়োগ করা ঠিক নয়। তবে একই ভাবে ইউরোপের সামন্ততন্ত্রে ধারনাও ভারতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ একইভাবে ঠিক ছিল না। ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট আছে। এর সাথে বিদেশের মিল থাকতে পারে, কিন্তু বিদেশের ছাঁচে ভারতকে বিচার করা কখনই সমিচীন নয়। 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...