বিজয়নগর রাজ্যের শিল্প, স্থাপত্য ও সাহিত্য
১৪ শতকের মাঝামাঝি সময় দিল্লি সুলতানির পতনের যুগে বিজয়নগর রাজ্য স্থাপিত হয়। এই রাজ্য ২০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল। দীর্ঘ সময় জুড়ে পার্শ্ববর্তী বাহমনি রাজ্যের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকলেও এই রাজ্যের অর্থনৈতিক অগ্রগতি স্থবির থাকেনি। বিজয়নগরের একটি আকর্ষক বিশেষত্ব এই যে এখানকার শাসকেরা সাহিত্য ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তাঁদের যোগ্য তত্ত্বাবধানে এই রাজ্যে কালজয়ী সাহিত্য, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এই রাজ্যে পায়েজ, নুনিজ, বারবােসা, নিকোলাে কন্টি, আবদুর বুজ্জাক প্রমুখ বিদেশি পর্যটক ভ্রমণে আসেন। তাঁরা তাঁদের বিবরণে তৎকালীন বিজয়নগরের সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছেন।
ভারতে সুলতানি শাসনকালে বিজয়নগর সাম্রাজ্য হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির মহান কেন্দ্র হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিল। সেই সময় রাজকীয় পৃষ্ঠপােষকতায় দক্ষিণ ভারতে সংস্কৃত ভাষা নবজীবন লাভ করেছিল। পাশাপাশি তামিল, তেলেগু, কন্নড় প্রভৃতি আলিক ভাষাও সেই সময় উৎকর্ষ লাভ করে। তেলুগু কবি শ্রীনাথ ও পেড্ডন, রাজা দ্বিতীয় দেবরায়ের সভাসদ কন্নড় কবি কুমারব্যাস প্রমুখ ছাড়াও রাজা কৃষ্ণদেবরায় স্বয়ং সংস্কৃত ও তেলেগু ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন
বিজয়নগরের রাজারা সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। বেদের বিখ্যাত টীকাকার মাধবাচার্য ও সায়নাচার্য বিজয়নগরের রাজাদের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেন। সায়নাচার্যের ভাই মাধববিদ্যারণ্যও একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। বিখ্যাত তেলুগু কবি শ্রীনাথ ও কন্নড় কবি কুমারব্যাস দ্বিতীয় দেবরায়ের রাজসভায় সভাসদ ছিলেন। রাজা কৃয়দেব রায়ের আমলে দক্ষিণ ভারতের সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল। রাজা কৃয়দেব রায়ের ২১ বছরের রাজত্বকাল ছিল বিজয়নগরের একটি গৌরবময় অধ্যায়। তিনি বিভিন্ন পণ্ডিতকে ভূমি ও অর্থ দান করতেন। তাঁর রাজসভায় ‘অষ্টদিগগজ’ নামে আটজন বিখ্যাত পণ্ডিতের সমাবেশ ঘটেছিল। তাদের মধ্যে সর্বাধিক বিখ্যাত ছিলেন তেলুগু কবি পেদ্দন। তিনি অন্ত্র কবিতার পিতামহ’ নামে পরিচিত। কৃয়দেব রায় নিজেও ছিলেন একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ওঁ সাহিত্যিক। তিনি সংস্কৃত ভাষায় পাঁচটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত বিখ্যাত সংস্কৃত নাটক হল জাম্ববতী কল্যাণম্। এ ছাড়া, রাষ্ট্রদর্শনের ওপর কৃষ্ণদেবরায় রচিত আমুক্তমাল্যদা তেলুগু সাহিত্যের একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। এই যুগে দর্শন, ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, সংগীত, নৃত্য প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে নানান গ্রন্থ রচিত হয়।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যে স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যে নগরজীবনের বিকাশ ঘটেছিল। নগরীর নির্মাণশৈলী ছিল অপরূপ। নগরীর চারদিক প্রাচীন, উদ্যান ও মন্দিরে সুসজ্জিত ছিল। কৃয়দেব রায়ের আমলে নির্মিত ‘হাজারা রামস্বামী মন্দির’ হিন্দু স্থাপত্যশিল্পের একটি উল্লেখযােগ্য নিদর্শন। এ ছাড়া, বিঠলস্বামী মন্দির, কৃয়স্বামী মন্দির এই সময়ের উল্লেখযােগ্য শিল্প নিদর্শন। শিল্প সমালােচক ফার্গুসন বিঠলস্বামী মন্দিরকে দ্রাবিড় শিল্পরীতির অপূর্ব নিদর্শন বলে বর্ণনা করেছেন। পায়েজ বলেছেন যে, বিজয়নগরের রাজপ্রাসাদটি লিসবনের রাজপ্রাসাদের চেয়েও বৃহৎ ছিল। বিজয়নগরের স্থাপত্যশিল্পে ইন্দো-পারসিক শিল্পরীতির সংমিশ্রণ ঘটেছিল।
চিত্রশিল্প ও সংগীত চর্চায় বিজয়নগরে যথেষ্ট উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। শিল্প গবেষক এস. কে. সরস্বতী বলেছেন যে, বিজয়নগরে চিত্রশিল্প ও স্থাপত্যশিল্প, উভয় ক্ষেত্রেই অলংকরণের উৎকর্ষ দেখা যায়। রাজা কৃয়দেব রায় এবং রাম রায় খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ ছিলেন। সে যুগে সংগীত বিষয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। বিজয়নগরের নাট্যশালাও গড়ে উঠেছিল। জনগণকে আনন্দদানের জন্য অভিনয়ের ব্যবস্থা ছিল।
বিজয়নগরে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সম্বয় ঘটেছিল। সাম্রাজ্যে হিন্দু সংস্কৃতির প্রাধান্য থাকলেও শাসকগণ ধর্মীয় ক্ষেত্রে খুবই উদার ছিলেন। শাসনব্যবস্থায়ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করা হত। পাের্তুগিজ পর্যটক বারবােসা রাজা কৃয়দেব রায়ের আমলের ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে লিখেছেন যে, তাঁর সাম্রাজ্যে যে কেউ আসতে পারত, সেখানে অবস্থান করতে পারত এবং নিজধর্ম পালন করে শান্তিতে বসবাস করতে পারত। সে খ্রিস্টান, ইহুদি, নিগ্রো বা ধর্মহীন কি না—এ বিষয়ে কেউ তাকে প্রশ্ন করত না।
বিজয়নগরের সাংস্কৃতিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দারুণ অগ্রগতি ঘটেছিল। কৃয়দেব রায়ের আমল এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইতিহাসবিদ ড. কালীকিঙ্কর দত্ত বলেছেন যে, কৃয়দেব রায়ের রাজত্বকাল শুধু বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের জন্যই বিখ্যাত নয়, শিল্প ও সাহিত্যের বিকাশ এবং পৃষ্ঠপােষকতার জন্যও উল্লেখযােগ্য।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন