সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শশাঙ্ক | Shashanka

 শশাঙ্ক 

সপ্তম শতকের প্রথমার্ধ বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য পর্ব। এই সময় বাংলায় শশাঙ্ক নামে এক রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব হয়, যার নেতৃত্বে গৌড়কে কেন্দ্র করে বাংলা উত্তর ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। শশাঙ্ক ও তাঁর রাজত্বকাল সম্পর্কে তথ্য প্রদানকারী প্রধান দুটি উপাদান হল হিউয়েন সাং এর বিবরনী এবং বাণভট্টের হর্ষচরিত। এঁরা দুজনেই কনৌজ ও থানেশ্বরের রাজা হর্ষবর্ধনের অনুগ্রহভাজন ছিলেন। তাই এই দুটি উপাদান শশাঙ্ক সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট মন্তব্য করেছে। এছড়া রয়েছে বৌদ্ধ গ্রন্থ আরযমঞ্জুশ্রীমূলকল্প এবং শশাঙ্কের গঞ্জাম লেখ, মেদিনীপুর লেখ এবং কিছু মুদ্রা। 

পরবর্তী গুপ্ত শাসনে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হয়ে গেছিল। কেবল উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গ তাঁদের অধীনে ছিল। কিন্তু নিয়ন্ত্রন শিথিল হয়ে পড়েছিল। এই সময়েই শশাঙ্কের আবির্ভাব হয়। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের ধারণা শশাঙ্ক পরবর্তী গুপ্ত শাসকদের অধীনস্ত বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন। পরবর্তী গুপ্ত শাসকদের দুর্বলতার ফলে সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন দেখা দিলে শশাঙ্ক গৌড় দেশে নিজেকে স্বাধীন নরপতি রূপে প্রতিষ্ঠা করেন। পন্ডিত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন শশাঙ্কের আসল নাম ছিল নরেন্দ্রগুপ্ত। এবং তাঁর উপাধি ছিল নরেন্দ্রাদিত্য। শাশাঙ্কের নামের শেষে 'গুপ্ত' কথাটি থাকার ফলে তাঁর গুপ্ত বংশ পরিচয় অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তাছাড়া তিনিও গুপ্ত শাসকদের মত মুদ্রায় কমলাসনা লক্ষ্মীর মূর্তি উৎকীর্ণ করতেন। তবে হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মত অনেক ঐতিহাসিক তাঁকে গুপ্তবংশীয় পুরুষ মনে করেন না। যাই হোক সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে যে শশাঙ্কের নেতৃত্বে যে 'গৌড়তন্ত্রের' আবির্ভাব হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণ।

সমগ্র বঙ্গদেশ শশাঙ্কের সাম্রাজ্যভূক্ত ছিল না। উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গ তাঁর শাসনাধীনে ছিল। হিউয়েন সাং লিখেছেন সমতট বা পূর্ববঙ্গ স্বাধীন ছিল। তবে তিনি মগধ, উৎকল ও কঙ্গোদ রাজ্যকে নিজ শাসনাধীনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। দক্ষিণ উড়িশার শৈলদ্ভব রাজারা শশাঙ্কের আধিপত্য স্বীকার করে নিয়েছিল। 

শশাঙ্কের বিদেশনীতি ছিল আগ্রাসী। পরবর্তী গুপ্ত রাজারা তো স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর শত্রু ছিলেন।  বাংলার উত্তরে কামরূপ রাজ ভাস্করবর্মার সাথে তাঁর বিরোধ ছিল। এদিকে কনৌজ রাজ গ্রহবর্মণ এবং থানেস্বরের পুষ্যভূতি বংশ শশাঙ্কের বিরোধী ছিল। থানেস্বর, কনৌজ এবং পরবর্তী গুপ্ত রাজারা শশাঙ্কের বিরুদ্ধে এক রাজনৈতিক জোট গঠন করেছিলেন। এই জোটে শশাঙ্ক সাথে পেয়েছিলেন মালব রাজ দেবগুপ্তকে। মালব রাজ দেবগুপ্ত কনৌজ আক্রমন করে গ্রহবর্মণকে পরাজিত করে হত্যা করেন এবং তাঁর স্ত্রী রাজ্যশ্রীকে বন্দি করেন। গ্রহবর্মণ ছিলেন থানেশ্বরের জামাতা। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নিহত রাজা গ্রহবর্মণের শ্যালক তথা থানেশ্বরের রাজা রাজ্যবর্ধন কনৌজ পুনরুদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন । এই যুদ্ধে মালবরাজ দেবগুপ্ত রাজ্যবর্ধনের হাতে পরাজিত ও নিহত হন। কিন্তু শশাঙ্কের হাতে রাজ্যবর্ধনও নিহত হন। এর পর থানেশ্বর ও কনৌজের রাজা হন হর্ষবর্ধন। তিনি  শশাঙ্কের বিরুদ্ধে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। শশাঙ্ক কনৌজ ত্যাগ করে গৌড়ে চলে আসেন। হর্ষ শশাঙ্কের রাজ্যের ক্ষতি করতে পারেন নি। শশাঙ্ক তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সগৌরবে রাজত্ব করেছিলেন এবং মগধ তাঁর অধিকারেই ছিল। 

শশাঙ্ক ধর্মীয় ক্ষেত্রে সহনশীলতার পরিচয় দিতে পারেন নি। তিনি ব্যাক্তিগতভাবে শৈব ছিলেন এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং বৌদ্ধধর্ম বিরোধীতার পরিচয় দিয়েছেন। হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায় তিনি কুশিনগর ও বিহারের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বহিষ্কার করেছিলেন। বুদ্ধগয়ার বৌদ্ধদের অতি প্রিয় ও পবিত্র বোধি বৃক্ষটি সমূলে নষ্ট করে দেন। পাটলিপুত্রে বুদ্ধের পদাঙ্কিত এক খন্ড প্রস্তর গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিলেন।  তাঁর এহেন অসহনশীলতার রাজনৈতিক কারনও থাকতে পারে। যেহেতু বিরোধী পক্ষ রাজা হর্ষ  বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তাই তাঁর বৌদ্ধদের উপর রাগ থাকতে পারে। তাছাড়া সেই সময় বাংলা ও আসামে ব্রাহ্ম্যন্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। শশাঙ্ক হয়ত তাঁরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। 

পরিশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে বাংলার উত্থানের প্রধান ও প্রথম কারিগর শশাঙ্কের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। তিনি হয়ত ধর্মপাল ও দেবপালের মত সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু বাংলাকে দিয়ে গেছেন স্বাধীনতার স্বাদ। পরবর্তীকালে পাল রাজাদের কাছে তিনি অনুশরনীয় হয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া সকলোত্তরপথনাথ হর্ষকে যদি কোনো শক্তি সার্থক প্রতিরোধ প্রদান করে থাকে তা হল চালুক্য রাজ পুলকেশি এবং গৌড় রাজ শশাঙ্ক। 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ