সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাংলায় বাণিজ্যিক কৃষি হিসাবে পাট চাষ | Jute Cultivation as a Cash Crop

 বাংলায় বাণিজ্যিক কৃষি হিসাবে পাট চাষ 

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সর্বপ্রথম নীল, পাট, তুলা এবং তৈলবীজ জাতীয় ভারতীয় কৃষিজ পণ্যাদির যে প্রচুর সম্ভাবনা আছে তা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। এই সময়ে ইংল্যান্ডে শিল্পোন্নতির ফলে এবং সেদেশে ভারতীয় শিল্পজাত পণ্যের আমদানির উপর আরোপিত সংরক্ষণমূলক নিয়ন্ত্রণবিধির চাপে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য নতুন নতুন কৃষিজ পণ্যের সম্ভাবনার দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য হয়। এভাবেই শুরু হয় ভারতে কৃষির বাণিজ্যিকিকরণ। ইতিপূর্বে ভারতের চাষিরা যেখানে ধান, গম, জোয়ার, বাজরা, ডাল, তৈলবীজ, মশলা প্রভৃতি খ্যাদ্যপণ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দিত সেখানে এখন অতি দ্রুত গুরুত্ব পেতে থাকে পাট, তুলা, নীল প্রভৃতি বাণিজ্যিক শষ্য, যা মূলত ইংল্যান্ডের শিল্পউৎপাদনের জন্য অপরিহার্য। ১৮৫০ এর দশকে দেশের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলসমূহ রেলপথ দ্বারা সংযুক্ত হলে এবং সামুদ্রিক পরিবহনের উন্নতির ফলে ভারী সামগ্রীসমূহ বিদেশে প্রেরণ সহজতর হলে ভারতের কৃষিজ পণ্যের রপ্তানীর আয়তন আরও দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। ১৮৩৩ এর পর বাণিজ্যিক সংস্থা হিসাবে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে গেল এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগ নতুন উদ্যোম প্রদর্শন করল। এই প্রেক্ষাপটেই ভারতে বাণিজ্যিক শষ্য উৎপাদন বহুগুন বেড়ে গেল।

পাট বাংলা তথা ভারতের একটি প্রধান বাণিজ্যিক পণ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। পাট চাষে লাভের দিকে নজর রেখে একে বাংলার 'সোনালি তন্তু' বলা হয়। ১৮৩০ এর পর থেকে বাংলায় পাট উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। উৎপাদিত পাটের ৯০% ছিল বাংলার পাট। পূর্ববাংলার নারায়নগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ এবং চাঁদপুরে প্রচুর পাট ক্ষেত ছিল। পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদ, নদীয়া এবং ২৪ পরগানায় পাট চাষ হত।   বাংলায় পাট চাষের আধিক্য থাকলেও বিহার, আসাম ও ওড়িশাতেও পাট চাষ হত।  

১৯ শতকের শেষের বছরগুলোতে কাঁচা পাট ভারতীয় রপ্তানি তালিকাভুক্ত হলে পাট চাষের এলাকা বেশ ভালো পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। দেশের ভিতর পাটকলের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী মন্দার পূর্বের বছরগুলিতে কাঁচা পাটের রপ্তানিও বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিশ্বব্যাপী মন্দার (১৯২৯) প্রাক্কালে কাঁচা পাট রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৯ লক্ষ টন। মন্দা কাঁচা পাটের রপ্তানিকে গুরুতর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল এবং এর ফলে ১৯৩৩ সালে কাঁচা পাটের রপ্তানি হ্রাস পেয়ে হয়েছিল মাত্র ৫.৬ লক্ষ টন। আরও বেশি বিপর্যয়কর ছিল কাঁচা পাটের মূল্য হ্রাস। ১৯২৮ সালে কাঁচা পাটের দাম টন প্রতি ৩৫৫ টাকা থেকে কমে ১৯৩৩-৩৪ সালে প্রতি টন ১৭৫ টাকায় নেমে এসেছিল। পরবর্তী বছরগুলিতে কাঁচা পাটের মূল্য এবং রপ্তানি কিছু পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। মূল্য বৃদ্ধি করার জন্য ১৯৩৫ সালে স্বেচ্ছামূলক ভিত্তিতে পাট চাষের এলাকা সংকোচনের এক পরিকল্পনা বাংলা সরকার গ্রহণ করে। ১৯৪০ সালে একে বাধ্যতামূলক করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় পাটকলগুলি উৎপাদন বৃদ্ধি করায় কাঁচা পাটের রপ্তানি হ্রাস পেয়েছিল। ভারতের বিভাগের প্রাক্কালে রপ্তানি পরিমান ছিল ৩.১ লক্ষ টন এবং ইহার মূল্য ছিল ১৯ কোটি টাকা। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ