TISCO | টাটা আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানি
আধুনিক ভারতে যে সকল আধুনিক শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল লৌহ ইস্পাত শিল্প তার মধ্যে অন্যতম। রেলপথ ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশের ফলে ভারতে লৌহ-ইস্পাত শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। ১৮৭৫ খ্রিঃ বরাকরে বেঙ্গল আয়রন এণ্ড স্টিল কোম্পানি (BISCO) তৈরি হয়েছিল। ১৯০৩ সালে এই কোম্পানি ইস্পাত নির্মাণের উদ্যোগ নেয়, কিন্তু তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ভারতের ইস্পাত শিল্পের ইতিহাস মুলত টাটা আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানির (TISCO) ইতিহাস। TISCO গড়ে ওঠার ইতিহাসে তিনজন ব্যক্তির নাম অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। এঁরা হলেন জামশেদজি টাটা, তাঁর পুত্র দোরাবজি টাটা এবং ভূতত্ত্ববিদ প্রেমনাথ বসু। ১৯০৩-৪ সালে প্রেমনাথ বসু ওড়িশার ময়ুরভঞ্জ এলাকায় আকরিক লোহার খনি আবিস্কার করেন। এই এলাকা ছিল বাংলার কয়লা খনি গুলির খুব কাছে অবস্থিত। এর পর জামশেদপুরকে বেছে নেওয়া হয় ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলার জন্য। TISCO গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভারতের ঔপনিবেশিক সরকারের গুরুত্ব কম নয়। ১৯০৫ সালে ভারত সরকারের বাণিজ্য ও শিল্প দপ্তর সরকারি রেলের তরফে টাটাদের সাথে এক দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে। ঠিক হয় যে আগামী ১০ বছরে রেল কোম্পানী টাটাদের কাছ থেকে ২০,০০০ টন ইস্পাত নির্মিত রেল কিনবে। এভাবে TISCO সরকারের তরফ থেকে প্রাথমিক সংরক্ষণ পেয়ে যায়। ১৯০৭ সালে TISCO বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ কোম্পানিতে নথিভুক্ত হয়। প্রাথমিক পুঁজির পরিমান ছিল ২৩ মিলিয়ন টাকা। টাটা পরিবারের সদস্য, পরিচিত ব্যবসায়ী এবং দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে এর শেয়ার বিক্রি হয়। ১৯১২ সালে প্রথম প্রথম ইস্পাত তৈরি হয়। TISCO প্রথম থেকেই মার্কিন প্রযুক্তি এবং বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভরশীল ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল টাটা কোম্পানির কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দরুন জার্মানি এবং বেলজিয়াম থেকে ভারতে ইস্পাত আমদানি বন্ধ হয়ে যায় এবং ব্রিটেন থেকে আমদানিকৃত ইস্পাতের পরিমাণ ছিল অপর্যাপ্ত। এদিকে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জাম নির্মাণের ব্যাপক লোহার প্রয়োজন ছিল। এই প্রেক্ষাপটে সরকার টাটা কোম্পানির যাবতীয় ইস্পাত কিনে নিতে থাকে। সরকারি আনুকুল্য আরো বেশি করে পাওয়ার আশায় টাটারা সরকারকে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তারা তাৎক্ষনিক লাভের মোহ ত্যাগ করে সরকারকে ইস্পাত সরবরাহ করতে থাকে। এর সুফল আসে ১৯১৭ সালে। টাটারা যখন বিদেশ থেকে সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি আরো বেশি পরিমাণে আমদানি করে কোম্পানির সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেই সময় তারা সরকারের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর টাটা কোম্পানি তার প্রতিযোগিদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানায়। যুদ্ধের সময় সরকারকে সহযোগিতা করার পুরস্কার হিসেবে তারা পায় Steel Industry [Protection] Act (১৯২৪). এই আইন অনুযায়ী আমদানিকৃত ইস্পাতের ওপরে ২.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৩.৩ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়। একই সাথে ভারতীয় রেলকে ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি সংরক্ষণ নীতির সুবিধা পেয়ে TISCO-র দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। ১৯২৯ এর বিশ্বব্যাপী আর্থিক মহামন্দার প্রভাব ভারতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন অংশকে আঘাত করলেও TISCO সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ১৯৩৮-৩৯ সাল নাগাদ দেখা গেল ভারতীয় রেল তার প্রয়োজনীয় ইস্পাতের ৯৯ শতাংশই ক্রয় করছে টাটা দের কাছ থেকে এবং ভারতীয় ইস্পাত বাজারের প্রায় ৭৩ শতাংশ টাটা নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন