মোপলা বিদ্রোহ | Malabar Rebellion
উনিশ শতকের কৃষক বিদ্রোহগুলির মধ্যে অন্যতম হল মালাবার অঞ্চলের মোপলা বিদ্রোহ (১৮৪৯-৫২)। মোপলারা আরব ব্যবসায়ীদের উত্তরপুরুষ। মালাবার উপকূলে আগত আরব ব্যবসায়ীদের একটি অংশ দেশে ফিরে না গিয়ে স্থানীয় নায়ার ও তিয়ার মহিলাদের সঙ্গে বিবাহ করে মালাবার এলাকাতেই থেকে যায় এবং কৃষিকাজকে পেশা হিসাবে বেছে নেয়। স্থানীয় দাস জাতি ছিল চেরুমা। ১৮৪৩ সালে দাস প্রথা অবলুপ্তি আইন পাশ হলে চেরুমা-রা মুক্তি পায় কিন্তু সমাজ তাদের ঠাঁই দেয় নি। ফলে এঁরা ইসলাম গ্রহণ করে। এভাবে মোপলারা সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়। এরা বেশিরভাগই ছিল ভূমিহীন কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী বা জেলে। ১৭৯২ সালে মালাবার ব্রিটিশ অধিকারে আসে এবং মালাবার এলাকায় নতুন ভূমি ব্যবস্থা চালু হয়, যাতে স্থানীয় হিন্দু জেন্মিরা জমির মালিক হিসাবে পরিগনিত হন এবং কৃষক ও কনমদার (ভূমিস্বত্ব ভোগ দখলকারী) দের জমি থেকে উৎখাত করার অধিকার পেয়ে যান। এতদিন জেনমি, কনমদার ও কৃষকের মধ্যে উৎপন্ন সমান সমান ভাগাভাগি হত। এই নতুন ব্যবস্থা মোপলা কৃষকদের চুড়ান্ত প্রতিকূলে যায় এবং এই শ্রেনীর মধ্যে বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়। উচ্চ কর হার এবং আইন বহির্ভূত কর আদায়, পুলিশ ও বিচার বিভাগের পক্ষপাতিত্ব সব মিলিয়ে মোপলা কৃষকরা ক্রমশ বিদ্রোহপ্রবণ হয়ে ওঠে।
কৃষিজ ও শ্রেণী সম্পর্কের সাথে যুক্ত হয়েছিল ধর্মীয় উন্মাদনা। জেন্মিদের প্রায় সকলেই ছিল হিন্দু এবং মোপলারা ছিল মুসলমান। তাই ধর্ম ও অর্থনৈতিক অভিযোগ মিলে মিশে প্রকাশ্য প্রতিরোধের মানসিকতা প্রস্তুত হয়। মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা যেমন উমর কাজী, সৈয়দ আলাবী টঙ্গল, সৈয়দ ফজল পুক্কোয়া, সৈয়দ সানা উল্লা মুক্তি প্রমুখরা জেহাদের একটা জনপ্রিয় মতাদর্শ গড়ে তোলেন। পুরো উনিশ শতক জুড়ে মালাবারের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে। বিদ্রোহীরা জমায়েত হত মসজিদে আর তাদের লক্ষ্য ছিল জেন্মিরা আর তাদের মন্দির এবং তাদের সহযোগী তথা ত্রাতা ব্রিটিশ করমচারীগন। এই পর্বের বিদ্রোহে তিনটি ঘটনা ছিল সাংঘাতি-- ১. মঞ্জেরির ঘটনা (১৮৪৯), ২. কুলাথুরের ঘটনা (১৮৫১) এবং ৩. মাত্তানুরের ঘটনা (১৮৫২)। যদিও ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাবাহিনী নামায়। ব্যপক দমনমুলক ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে বিদ্রোহ দমন হয়।
প্রাথমিক পর্বের বিদ্রোহ দমিত হলেও মোপলাদের অভিযোগ তথা আক্রোশ থেকেই যায়, যার বহিপ্রকাশ ঘটে একের পর বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। ১৮৮৫ সাল নাগাদ দ্বিতীয় মোপলা বিদ্রোহ হয় যা দমন করতে ব্রিটিশ সরকার তিন হাজার সৈন্য ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়োগ করে। এই দ্বিতীয় বিদ্রোহ দেড় বছর স্থায়ী হয়। বিদ্রোহীদের পরাজয় ঘটে। তাদের নির্মম ভাবে দমন করা হয় 'পিটুনি কর' বসিয়ে ও দ্বীপান্তর পাঠিয়ে। ১৮৯৪ সালে তৃতীয় মোপলা বিদ্রোহ এবং ১৮৯৬ তে চতুর্থ মোপলা বিদ্রোহ ঘটে। সবকটি বিদ্রোহই কঠোর ও নির্মম হাতে দমন করা হয়। চতুর্থ মোপলা বিদ্রোহে ভীত শাসকগোষ্ঠী জমিদারদের বর্ধিত খাজনা ও মহাজনদের সুদ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, যদিও সামন্ত শ্রেনী তাদের বহু উপায়ে শাসন শোষন অব্যাহত রেখেছিল।
১৯২১ সালের আগস্ট মাসে মোপলারা আবার বিদ্রোহী হয় ও স্বাধীন খেলাফত রাজ্য স্থাপন করে। ব্রিটিশ সরকার মালাবারে সৈন্য, ছোটবড়ো ট্যাংক, কামান, বোমা, কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ পাঠায়। প্রথমদিকে কয়েকজন অত্যাচারী জমিদার ও মহাজন জনরোষে প্রাণ হারায়। ব্রিটিশ সরকার একে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে ও কিয়দংশে সফল হয়। দেশের বুদ্ধিজীবী মহলের বৃহৎ অংশ মোপলাদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার প্রসঙ্গে নীরব থাকেন। বিদ্রোহীরা একমাস যুদ্ধ চালালেও, সরকার মোপলা এলাকাসমূহের উপর আকাশ থেকে বোমা নিক্ষেপ, রণতরী ও কামান থেকে নির্বিচারে গোলাবর্ষন করে প্রায় দশ হাজার সাধারণ মানুষ হত্যা করে, তাদের বাড়ীঘর, দোকান-পাট ও ক্ষেত-খামার ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। ধরপাকড়, পৈশাচিক অত্যাচার ও নির্যাতনের ফলে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। প্রায় একশো মোপলা প্রজাকে গ্রেফতার করে একটি মালগাড়ীতে বোঝাই করা হয় এবং দরজা বন্ধ করে তাদেরকে কালিকট প্রেরণ করার সময় ষাটজনের মৃত্যু হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন