সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের রচনা | François Bernier

ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের রচনা | François Bernier

আকবরের রাজত্বকাল থেকেই মুঘল দরবারের সঙ্গে ইউরোপীয়দের যোগাযোগের সূচনা হয়। শাহজাহানের দরবারে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ইউরোপীয় পর্যটকের আগমন হয়েছিল। এরা হলেন ট্যাভার্নিয়ে, পিটার মান্ড্‌ মানুচি এবং বার্নিয়ে। বার্নিয়ে ছিলেন একজন ফরাসি চিকিৎসক। শাহজাহানের রাজত্বকালের শেষ দিকে, ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে উত্তরাধিকারী দ্বন্দ্বের সময় তিনি ভারতবর্ষে এসেছিলেন এবং ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এদেশে ছিলেন। তার লেখা বিতর্কিত গ্রন্থটি হল The War of Succession of 1658. এই গ্রন্থটি একসময় নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হলেও আধুনিক ঐতিহাসিকরা এই গ্রন্থের ঐতিহাসিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

অন্যান্য ইউরোপীয় পর্যটকদের মত বার্নিয়েও তাঁর স্বদেশের সাথে ভারতের তুলনা করতে গিয়ে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবমুল্যায়ন করেছেন। তিনি লিখেছেন ভারতে কোনো রাষ্ট্র নেই। এখানে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রবল দ্বন্দ্ব চলে। জ্যেষ্ঠ পুত্রের উত্তরাধিকার স্বীকৃত থাকলে এমন হত না। আসলে বার্নিয়ে যখন ভারতে এসেছিলেন তখন শাহাজাহানের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব চলছিল। তাই তাঁর লেখায় উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। তবে তিনি ঔরঙ্গজেবের দক্ষতা ও কূটনীতির প্রশংশা করেছেন এবং তাঁর সাথে ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের তুলনা করেছেন।

ভূসম্পত্তির মালিকানা প্রসঙ্গেও তিনি মতামত দিয়েছেন। তাঁর মতে ভারতে সকল জমির মালিক সম্রাট, আমির-ওমরাহ থেকে শুরু করে সাধারন কৃষক পর্যন্ত কারোর জমির উপর মালিকানা ছিল না। জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত না হওয়ায় সামাজিক অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়। জাগিরদার, জমিদার ও চৌধুরিরা নির্মম অত্যাচার করে কেবল রাজস্ব আদায় করে। জমির উন্নতির দিকে নজর নেই তাদের। ইউরোপের সামন্ত ব্যবস্থায় জমির মালিকানা স্বীকৃত হওয়ায় সেখানের কৃষির অগ্রগতি হয় এবং এর ফলে কারিগরি উৎপাদন, ব্যবসা উন্নত হয় এবং নগরায়ন হয়। ভারতে সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত না হওয়ায় ভারত সামন্ততন্ত্রের সুফল ভোগ করতে পারে নি। 

বার্নিয়ে এদেশের মানুষের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি লিখেছেন বাদশাহ ও আমিরগন ছিলেন অশিক্ষিত বা কুশিক্ষিত এবং মানষিকভাবে অপরিণত। এঁরা ছিলেন পশুর চেয়েও নিষ্ঠুর। শাসনকার্যে এদের বিশেষ জ্ঞান ছিল না। মুঘল শাসকদের পাঠানরা পছন্দ করতেন না। মুঘলরা বেশি করে হিন্দুদের উপর নিরভরশীল ছিলেন শাসন চালানোর ব্যপারে। ভারতীয়দের জীবনযাত্রা সম্পর্কেও তাঁর ধারণা ইতিবাচক নয়। তিনি লিখেছেন শাসকগন ভোগবিলাস, সোনা-রুপা আর উপপত্নীতে খরচ করে আর সাধারন ভারতীয়রা অর্জিত অর্থ দিয়ে সোনা রূপা ক্রয় করে তা মাটির তলায় মজুত রাখে এবং ভিক্ষুকের মত জীবনযাপন করে। তিনি আরও লিখেছেন, ভারতীয়দের কোনো শিল্পবোধ নেই। এখানে শিল্পের কোনো কদর নেই। এখানে শিখা-দীক্ষার কোনো বালাই নেই। কোনো আইন-আদালত নেই। ভারতবাসীর কোনো 'সামাজিক প্রথা' নেই। বণিকদের কোনো স্বাধীনতা ও সম্মান নেই। বাদশাহ চারিদিকে নিরক্ষর ও ক্রীতদাস দ্বারা পরিবৃত্ত থাকেন।

একসময় বার্নিয়ের রচনা ঐতিহাসিকদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকগন বার্নিয়ের বিবিরিণকে ঐতিহাসিক তথ্য হিসাবে স্বীকার করেন না। মধ্যযুগের স্বভাবজাত কিছু ত্রুটি অবশ্যই ছিল। তবে ভারতবাসীর শিক্ষাদীক্ষা নেই, শিল্প বোধ নেই, বাণিজ্য নেই, বিচার নেই, সামাজিক প্রথা নেই একথা তিনি কিভাবে লিখলেন তা ভাবতেই অবাক লাগে। তিনি যে সময়ের ফ্রান্সের সাথে আর ভারতের আর যে শাসকের সাথে ঔরঙ্গজেবের তুলনা টেনেছেন তাঁর সম্পর্কে দু-এক কথা না বললে নয়। সে সময় ফ্রান্সে অবস্থান করছে বাস্তিল দুর্গ, যা রাজকীয় স্বৈরাচারের চুড়ান্ত দৃষ্টান্ত, রয়েছে লেত্রে দ্যা ক্যাশে, লেত্রে দ্যা গ্রেস এর মত স্বৈরাচারী আইন। যেখানে রাজা চতুর্দশ লুই বলছেন "আমার ইচ্ছাই আইন" সেখানে ভারতবর্ষে তৈরি হয়েছে তাজমহলের মত সমাধি, দারাশিকোর মত পন্ডিত প্রভৃতি। মনে হয় প্রাচ্য দেশের প্রতি ইউরোপীয়দের স্বভাবজাত যে ঘৃণার দৃষ্টিভঙ্গি তার দ্বারা চালিত হয়েই বার্নিয়ে এভাবে মুঘল ভারতের অবমূল্যায়ন করেছেন।  

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ