দাক্ষিনাত্য বিদ্রোহ
উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ভারতে যেসব কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ১৮৭৫ এর দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ তার মধ্যে অন্যতম। মহারাষ্ট্রের এই কৃষক অসন্তোষের পশ্চাতে ছিল ঔপনিবেশিক সরকার প্রবর্তিত রাওতওয়ারি ব্যবস্থা এবং মহাজনি শোষণ।
রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় রাজস্বের হার ছিল যথেষ্ট উঁচু। এই ব্যবস্থায় সরকার সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করত। রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন গ্রামের প্যাটেল বা মোড়লরা। খরা প্রবন মহারাষ্ট্রে প্রায়ই উৎপাদনে ঘাটতি হত এবং এর ফলে কৃষকরা সরকারের খাজনার দাবি মেটাতে পারত না। তখন তারা মাড়োয়ারি মহাজন সাউকার এবং গুজরাটি মহাজন বনি'র দ্বারস্ত হত। সাধারন কৃষকদের কুনবি বলা হত। সাউকার ও বনি'রা কুনবি দের জমি দেনার দায়ে গ্রাস করে নিতে সর্বদাই উৎসাহী থাকত। তবে অনেক পন্ডিত দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহের পশ্চাতে এই মহাজনি শোষণকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চান না। তাঁদের মতে, N. Charlesworth তাঁর Myth of Deccan Riots গ্রন্থে দেখিয়েছেন কৃষজমির কেবল ৫% মহাজনেদের হস্তগত হয়েছিল। আর এদের মধ্যে স্থানীয় মহাজনই বেশি ছিলেন। কিন্তু কৃষকরা বহিরাগত কৃষকদের আক্রমণের মুলত টার্গেট করেছিল। তিনি আরও দেখিয়েছেন যেসব অঞ্চলে বিদ্রোহের ব্যপকতা বেশি ছিল সেসব অঞ্চলে খাজনা বৃদ্ধি করা হয়নি। আর যেখানে খাজনা বাড়ানো হয়েছিল সেখানে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারন করেনি। অধ্যাপক চিত্তব্রত পালিত আবশ্য চার্লসওয়ারথ এর বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেছেন যে মহাজনেরা যে ৫% জমি দখল করেছিল সেটি ছিল সর্বাধিক উর্বর ও দামি। এই জমিগুলো হস্তচ্যুত হওয়ার ফলে কৃষকরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল।
১৮৬০ এর দশকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ফলে ওই দেশ থেকে তুলা আমদানি কমে গেলে ভারতের তুলো চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু গৃহযুদ্ধের অবসানের পর পুনরায় আমেরিকার আমদানি স্বাভাবিক হলে ভারতে তুলোর দাম পড়ে যায়। প্রতি বেল তুলোর দাম ২১.৫ পাউন্ড থেকে কমে দাঁড়ায় ৮.৫ পাউন্ডে। এর ফলে কৃষকরা যখন দিশেহারা তখন ১৮৬৭ নাগাদ সরকার খাজনার হার অনেকটা বাড়িয়ে দেয়।
একই সময় ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয় কৃষকদের অবস্থাকে অসহনীয় করে তোলে। ১৮৬৬৭ তে দাক্ষিণাত্যের টানা অনাবৃষ্টি এবং ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ অজান্মা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে তোলে। এই সময় বিকল্প জীবিকা হিসেবে কৃষকরা রেলপথে দিনমজুরের কাজ বেছে নেয়। কিন্তু ১৮৭১-৭২ খ্রিস্টাব্দে সরকার রেলপথ নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দিলে কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। নিরুপায় হয়ে তারা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে রাজস্ব মিটিয়ে চাষবাস শুরু করে এবং ওই ঋণের জালেই বন্ধকি জমি মহাজনদের কবলে চলে যায়। এক্ষেত্রে অবশ্য ইংরেজ আইন-আদালত এবং প্রশাসনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ যেকোনো মামলায় বিচারের রায় সবসময় মহাজনদের পক্ষেই যেত।
১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে সিরুর তালুকের করদা গ্রামের কৃষকেরা কালুরাম নামে জনৈক্ মারোয়ারি মহাজনকে আক্রমণ করে বিদ্রোহের শুভ সূচনা করে। ১৮৭৫ সালে পুনা ও আহম্মদনগরে বিদ্রোহী কৃষকেরা ব্যাপক আক্রমণ করে। সরকারের হিসাব অনুযায়ী ৩৩ টি গ্রামে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই হিসাবকে সম্ভবত ইচ্ছা করে ছোট করে দেখানো হয়েছিল। উত্তর-দক্ষিণে ৬৫ কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল। কৃষকদের মূল লক্ষ্য ছিল মহাজনদের দলিলপত্রকে ধ্বংস করে দেওয়া। সামগ্রিক হাঙ্গামাতে, মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ৫ জন মহাজনের। অর্থাৎ বিদ্রোহীদের হত্যা বা শারীরিক নির্যাতন করার প্রবণতা ছিল না। তারা চেয়েছিল ঋণের নথিপত্র নষ্ট করে দিতে। বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন বেঙ্গলিয়া। বিদ্রোহের তীব্রতায় গুজরাটি ও মারওয়ারি মহাজনরা অনেকেই ঘর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়।
বিদ্রোহের তীব্রতা সরকারকে বিচলিত করে। উপদ্রুত এলাকায় পুলিশ পাঠিয়ে বিদ্রোহীদের ব্যাপক হারে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশি সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বিদ্রোহ দমন করা হয়। বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তা সম্পূর্ণ ভাবে বিফলে যায়নি। সরকার কৃষকদের স্বার্থ সম্পর্কে কিছুটা সচেতন হয়ে ওঠে। কৃষকদের অবস্থা পর্যালোচনার জন্য দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ কমিশন (১৮৭৬) নিযুক্ত করা হয়। এই কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে পাশ করা হয় দাক্ষিণাত্য প্রজাস্বত্ব আইন (Deccan Agriculturalist Relief Act)। এর দ্বারা মহজনদের অবাধ কার্যকলাপ কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং জমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও কিছু বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন