মুঘল চিত্রকলায় জাহাঙ্গিরের অবদান
মুঘল চিত্রকলাকে বলা হয় ইন্দো-পারসিক চিত্রকলা। হুমায়নের হাত ধরে প্রথম এই ইন্দো-পারসিক চিত্রকলার সূচনা হয় এবং আকবরের রাজত্বকালে তা বিকশিত হয়। কিন্তু জাহাঙ্গিরের রাজত্বকাল ছিল মুঘল চিত্রকলার স্বর্ণযুগ। জাহাঙ্গির ছিলেন অসম্ভব প্রকৃতিপ্রেমিক। নিসর্গ প্রকৃতির টানে তিনি ১৯ বার কাশ্মীর গিয়েছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় অঙ্কিত চিত্রকলায় তাই প্রাকৃতিক দৃশ্য সবথেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। তবে পশুপাখির চিত্র, বিশিষ্ঠ ব্যক্তির অবয়ব বা রাজনৈতিক ঘটনাবলী একেবারে বাদ যায় নি।
জাহাঙ্গিরের দরবারের প্রধান শিল্পী ছিলেন হিরাটের আগা রিজা। ইনি প্রখ্যাত চিত্রকর আবু-ই-হাসানের পুত্র। তাঁর দরবারের অন্যান্য চিত্রকরদের মধ্যে ছিলেন ফারুক বেগ, আব্দুস সামাদ, মহম্মদ নাদির, মহম্মদ মুরাদ, উস্তাদ মনসুর, মনোহর, বিষণ দাস, গোবর্ধন, আবুল হাসান, বিচিত্র প্রমুখ। এদের মধ্যে উস্তাদ মনসুরের কথা উল্লেখ করতেই হয়। ইনি পশুপাখির একেবারে জীবন্ত চিত্র এঁকে দিতে পারতেন। তাঁর আঁকা সাইবেরিয়ান সারস একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি। কলকাতা মিউজিয়ামে এটি সংরক্ষিত আছে। রঙের ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন আবুল হাসান। প্রতিকৃতি অঙ্কনে বিপ্লব এনেছিলেন বিষণ দাস, ফারুক বেগ এবং বিচিত্র। বিচিত্রের একটি ছবির কথা না বললে নয়; সেটি হল জাহাঙ্গির বিদ্ব্যানকে সম্মান দিচ্ছে। এই চিত্রে জাহাঙ্গিরের পৌঢ়, দুর্বল ও শিথিল শরীর এবং মুখের স্থির ও অলসভাব এতই স্পষ্ট যে তা থেকে জাহাঙ্গিরের বয়স অনুমান করা যায়।
জাহাঙ্গিরের সময়ে একাধিক গ্রন্থ অলংকৃত করা হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রাজকানোয়ার, নিজামুদ্দিন দলভির গজল ও রুবাইৎ , হাফিজের দিওয়ান ও আনোয়ার-ই-সুহেলি প্রভৃতি। জাহাঙ্গিরের চিত্রকলায় খ্রিস্টান প্রভাবও লক্ষ করা যায়। খ্রিস্ট ধর্মের বিষয়বস্তু, বিশেষ করে যিশুর প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়েছিল। ধর্মীয় বিষয়বস্তু নির্ভর আরও একটি ছবি হল আজমিরের খাজা বাবার দরগা পরিদর্শনের চিত্র। এমন কিছু চিত্র তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় অঙ্কিত হয়েছিল যেগুলি তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্যোতক; যেমন, ইরানের শাহ-কে তিনি বরন করছেন বা মালিক অম্বরের ছিন্ন মস্তকে আঘাত করছেন। জাহাঙ্গিরের চিত্রকলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল সাধারন মানুষের চিত্রাঙ্কন, যা ইতিপূর্বে দেখা যায় নি। বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের চিত্র, ক্লান্ত গ্রামবাসীর গ্রামীন জীবনের চিত্র তাঁর সময়ের অনবদ্য এক উদ্যোগ। তাঁর সময়ে পাড় চিত্রাঙ্কনেরও অগ্রগতি ঘটে। জ্যামিতিক ও আলংকারিক আকার ছাড়াও পশুপাখি, মানুষ ও প্রকৃতির চিত্রাবলী এখানে কদর পায়। কিন্তু শাহজাহানের সময় তা বন্ধ হয়ে যায়।
জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর পর মুঘল চিত্রকলার অন্তর্নিহিত প্রান ও সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। শাহাজাহান স্থাপত্য নির্মাণে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। চিত্রকলায় তাঁর বিশেষ উৎসাহ ছিল না। জাহাঙ্গিরের সময়েই মুঘল চিত্রকলা ইরানি প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ক্রমশ ভারতীয় শিল্পে পরিণত হয়। মহম্মদ নাদির ও মহম্মদ মুরাদের পর আর কোনো বিদেশি চিত্রকর আনা হয় নি। প্রতিকৃতি অঙ্কনে 'অর্ধ-মুখচিত্রন' রীতি চালু হয়, যা ভারতীয় রীতির বৈশিষ্ঠ। এদিক থেকে বলা যায় জাহাঙ্গিরের রাজত্বকাল ছিল মুঘল চিত্রকলার শ্রেষ্ঠ সময়।
ধন্যবাদ স্যার।
উত্তরমুছুনস্যার আমার মনে হয় আপনার মতো শিক্ষক আমাদের দেশে 100 ভাগের মধ্যে 30 ভাগ রয়েছে।
উত্তরমুছুন