সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মধ্যযুগে ইউরোপে গিল্ড | Guild in Medieval Europe

মধ্যযুগে ইউরোপে গিল্ড

গিল্ড হল কারিগর ও ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান। মধ্যযুগের ইউরোপের অর্থনীতিতে গিল্ডের ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কারিগরদের গিল্ডকে বলা হয় ক্রাফট গিল্ড ও ব্যবসায়ীদের ট্রেড গিল্ড বলে। শুধু অর্থনীতি নয় রাজনীতি এবং সাধারণ নাগরিক জীবনে গিল্ড গুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল।

দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ইউরোপে শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে অবাধ ও অসম প্রতিযোগিতারকে বাঞ্ছনীয় মনে করা হচ্ছিল না। একটা ধারণা জন্মাচ্ছিল যে, পণ্যের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য থাকা উচিত, উৎপাদনে নিযুক্ত কারিগরদের জীবীকার নিরাপত্তার প্রয়োজন এবং নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের উপায় থাকা দরকার। এইসব চাহিদা থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে গিল্ড গড়ে উঠেছিল। পণ্যমূল্য ন্যায্য রাখা ও তার মান ঠিক রাখার শর্তে নিজ নিজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গিল্ডগুলি একচেটিয়া অধিকার দাবি করত। 

গিল্ডের সংগঠন ছিল খুবই সুসংহত। গিল্ডের সদস্য ছিল মোট তিন প্রকার মালিক-শ্রমিক ও শিক্ষানবিশ। শিক্ষানবিশ পর্ব শেষ হবার পর প্রত্যেকেই শ্রমিক পদে উন্নীত হত। কর্তব্যের অবহেলা করলে শিক্ষানবিশদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার বিধান ছিল। মালিক ও শ্রমিক গিল্ডের পরিচালন কমিটির কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করতেন। বাইরের কোন কারিগর এর পক্ষে সংশ্লিষ্ট গিল্ডের অনুমতি ছাড়া শিল্পোৎপাদনে অংশ নেওয়া সম্ভব ছিল না। বিদেশি বণিকরাও শহরের বাণিজ্যিক ব্যাপারে বিনা অনুমতিতে যোগ দিতে পারত না। তবে একথাও ঠিক যে গিল্ড কেবল কারিগর ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করত তা নয়, ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারেও উদ্যোগ নিত। বণিক সংঘের সকল সদস্যই অর্থনৈতিক দিক থেকে সমান অধিকার ভোগ করত। কাঁচামাল ক্রয় এবং উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের ব্যাপারে সমান সুযোগ-সুবিধা দানের জন্য আইন প্রণয়ন করা হত। 

নগর প্রশাসনের ক্ষেত্রেও গিল্ডের কর্মকর্তাদের বিশেষ ভূমিকা থাকতো। তারা আধা সরকারি কর্মচারী রূপে প্রশাসনিক কাজকর্ম সামলাতেন। আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, আত্মরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা, উৎসব-পার্বণ পরিচালনার দায়িত্ব তাদের উপর বর্তাত। মধ্যযুগের শেষলগ্নে প্রায় সমগ্র পশ্চিম ইউরোপেরই গিল্ডগুলি নাগরিক জীবনের বিশেষ মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। 

গিল্ডের বিরুদ্ধে কতকগুলি অভিযোগ ছিল। গিল্ডের যথেচ্ছভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। গিল্ড গুলি পরবর্তীকালে সংকীর্ণতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতীক হয়ে ওঠে এবং নতুন উদ্যোগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। স্বার্থ সংরক্ষণেও তারা তৎপর হয়। সংগঠনের সদস্যদের স্বার্থ রক্ষায় গিল্ড গুলি এতটাই তৎপর হয়েছিল যে ধণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্থানের যেকোনো সম্ভাবনাকে তারা অঙ্কুরে বিনাশ করত। বাজারের উপর বিশেষ কোনো ব্যক্তি যেন কর্তৃত্ব স্থাপন করতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হত। 

মধ্যযুগে নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের জোগানের উপর কোনো গিল্ডেরই নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ছিল না। খুচরো বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতাও তাদের ছিল না। তাই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা গিল্ডগুলির পক্ষে খুব সহজ ছিল বলে মনে হয় না। তবে সর্বক্ষেত্রে গিল্ডের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়ের ফলে মোটামুটি উৎকৃষ্ট মানের পণ্যের উৎপাদন সুনিশ্চিত ছিল। সার্বজনীন হিতসাধনে গিল্ডগুলির ভূমিকা কতটা ছিল সে বিষয়ে সাধারন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। তবে উৎপাদন, বন্টন, পণ্যদ্রব্যের বিনিময় ব্যবস্থা প্রভৃতির উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ কার্যকরী করে তারা স্থায়ীভাবে বেকার সমস্যা সমাধান, ধর্মঘট, দালাল ও পাইকারদের অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ, অতিরিক্ত ধনসম্পদ সঞ্চয় প্রভৃতির কুফল থেকে গিল্ডগুলি জনগণকে রক্ষা করত। 

মধ্যযুগের বানিজ্যিক ক্ষেত্রে গিল্ডগুলি একটা স্থিতাবস্তা বজায় রাখতে চেয়েছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে মুলধন বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করার মত ক্ষমতা গিল্ড গুলির ছিল না। গিল্ডগুলি যৌথ কারবার সংগঠনের বিরোধী ছিল। একক সদস্যের দ্বারা যে মুলধন জোগাড় করা সম্ভব ছিলনা তা জোগাড় করার দ্বিতীয় পন্থা আর ছিল না। এদিক থেকে বিচার করলে গিল্ডগুলি শিল্পন্নতির পরিপন্থী হিসাবে কাজ করত। আর এজন্যই বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল। 

Guilds in Medieval Europe

Introduction
Guilds were organizations of craftsmen and merchants that played a significant role in the economy of medieval Europe. Craft guilds were associations of artisans, while trade guilds represented merchants. Guilds were not limited to economic functions; they also influenced politics and everyday civic life.

Emergence and Development
By the 12th century, unrestricted and unfair competition in the production sector was deemed undesirable in Europe. A growing belief emerged that there should be a balance between demand and supply of goods, the livelihoods of artisans needed protection, and a mechanism to control the inflation of essential goods was necessary. These demands led to the formation of guilds across various parts of Europe. Guilds claimed exclusive rights to production within their domain, provided the prices of goods were fair, and their quality was maintained.

Structure and Organization
Guilds were highly organized institutions. Members were categorized into three groups: masters, workers, and apprentices. Apprentices would be promoted to workers upon completing their training, and strict disciplinary measures were enforced for negligence. Guild committees, consisting of masters and workers, oversaw the administration. No external artisan could engage in production without guild approval, and foreign merchants needed permission to participate in local trade.

Guilds also sought to foster relationships between buyers and sellers. They worked to ensure economic equity among members, establishing laws to provide equal opportunities in purchasing raw materials and selling finished goods.

Role in Civic Administration
Guild officials often acted as semi-governmental agents, managing administrative duties like maintaining internal peace, organizing defense forces, and supervising festivals and celebrations. By the late medieval period, guilds had achieved a prestigious status in civic life across much of Western Europe.

Criticism and Decline
Guilds faced criticism for their arbitrary price hikes and misuse of power, prompting preventive measures against them. Over time, they became narrow-minded and reactionary, obstructing new initiatives and prioritizing the interests of their members to the detriment of broader economic growth. Guilds actively suppressed the rise of capitalism, ensuring that no individual gained excessive control over the market.

Despite their influence, guilds lacked absolute authority over the supply of essential goods and control over retail sellers, making it unlikely they could significantly inflate prices. However, guild-regulated production ensured the general quality of goods. While their contributions to public welfare remain debatable, guilds maintained strict control over production, distribution, and trade. This helped resolve unemployment issues, prevented undesirable interventions by brokers and wholesalers, and protected the public from excessive wealth accumulation and other market evils.

Impact on Trade and Industry
Guilds aimed to maintain stability in medieval commerce. They lacked the capital resources to expand production in response to growing populations and opposed the organization of joint enterprises. Since individual members could not raise the required capital, there were no alternative means to facilitate growth. Consequently, guilds often hindered industrial progress. This resistance to innovation eventually led to their decline as larger commercial enterprises gained dominance.

Conclusion
Guilds in medieval Europe sought to establish economic and social order, ensuring fair trade practices and quality control. However, their rigidity and resistance to change ultimately made them obstacles to industrial and commercial advancement. Despite their limitations, guilds played a pivotal role in shaping medieval economic systems and maintaining a semblance of stability in a rapidly evolving world.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...