সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

Globalisation: Defination & the Impact on Third World | বিশ্বায়নঃ সংজ্ঞা এবং তৃতীয় বিশ্বের উপর প্রভাব

বিশ্বায়নঃ সংজ্ঞা এবং তৃতীয় বিশ্বের উপর প্রভাব

সংজ্ঞা 

বিশ্বায়ন (Globalisation) বা ভুবনায়ন আজ অত্যন্ত পরিচিত একটি শব্দ। বিগত চার দশক ধরে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ও কর্মসূচী বিভিন্ন দেশের সমাজের সর্বস্তরকে প্রভাবিত করেছে। বিশ্বায়ন শব্দটি এত বিভিন্ন অর্থে এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যবহার করা হয় যে এর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা দেওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সাধারন ভাবে বিশ্বায়ন বলতে অর্থনৈতিক নীতি, পদ্ধতি ও কর্মকাণ্ডের ভুবনায়িত অবস্থাকে বোঝায়, যার মুল লক্ষ্য হবে বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও মুলধনের বিরাষ্ট্রীয়করণ তথা আন্তঃরাষ্ট্রীয়করণ। অর্থাৎ প্রযুক্তি, বাণিজ্য ও বাজারের মধ্যে কোনো রাষ্ট্রীয় সীমানার বেড়া না থাকা এবং সমস্ত বিশ্বটাকেই একটি বাজারে পরিণত করা। এই তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো দেশেরই প্রয়োজন পড়ে না স্বনির্ভর হওয়ার, কারণ সমস্ত পৃথিবীটাই এখানে পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বায়নের সাথে তাই মুক্ততা এবং উদারীকরণের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এখানের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও খবরদারি নেই। আছে একাধিক বৃহৎ বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থার (MNC) সক্রিয়তা, যাদের আর্থিক ক্ষমতা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে আর্থিক সঙ্গতির থেকে বেশি। 

পিটার মার্কাস মনে করেন, বিশ্বায়ন নতুন কোনো ব্যপার নয়। এটা হল একধরনের পুঁজিবাদ, বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদী সম্পর্কের বিস্তার। ১৯৭০ সাল থেকে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিস্তারের দুটি বিশেষ দিক লক্ষ করা যাচ্ছে-- ১) প্রযুক্তির উন্নতি এবং ২) ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন। পুঁজিবাদী বিশ্বের এই দুটি দিককে একত্রে বিশ্বায়ন বলা হয়।  দীপক নায়ারের মতে বিশ্বায়ন হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার সঙ্গে জড়িত থাকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক মুক্ত পরিবেশ এবং বিশ্ব অর্থনীতির অঙ্গীভূত দেশগুলির মধ্যে গভীর অর্থনৈতিক সমন্বয়। 


বিশ্বায়নের ধারনাটি কেবল অর্থনৈতিক কর্ম কান্ডেই সীমাবদ্ধ নেই। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এর বিস্তার লাভ হয়েছে। অধ্যাপক রোনাল্ড রবার্টসন প্রথম বিশ্বায়ন ধারনাটির অবতারণা করেছিলেন। তাঁর সংজ্ঞা অনুযায়ী, বিশ্বায়ন বলতে বিশ্বের সংকোচন এবং বিশ্বজোড়া পরস্পর নির্ভরশীলতার অবস্থাকে বোঝায়। অর্থাৎ, বিশ্বায়ন হল পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে পারস্পরিক নিরভরশীলতা। এন্টনি গিডেন্স প্রায় একইভাবে বলেন বিশ্বায়ন হল বিশ্বব্যাপী সামাজিক সম্পর্ক সমূহের এমন এক নিগূঢ়ীকরণ যার ফলে পৃথিবীর কোনো এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জীবনধারা শত মাইল দূরে সংঘটিত ঘটনাবলীর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।

তৃতীয় বিশ্বের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব 

তৃতীয় বিশ্বের প্রধান সমস্যা দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য ইত্যাদি। বিশ্বায়নের প্রবক্তারা বিশ্ববাসীকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল এক উন্নত, শোষনহীন, মানবাধিকার সমৃদ্ধ উজ্জ্বল পৃথিবী গড়ায়। তৃতীয় বিশ্ব অর্থাৎ এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলি সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিশ্বায়নের কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু এর ফল কি হল? অর্থাৎ, তৃতীয় বিশ্বের সমস্যাগুলি কতদূর সমাধান হল? এর উত্তর অবশ্যই নেতিবাচক। উন্নয়নশীল দেশগুলি আমদানি শুল্ক কমিয়ে, সংরক্ষনের নীতি বর্জন করে পুঁজির জন্য দেশের দরজা খুলে দিয়েছে মুক্ত অর্থনীতির নিয়ম মেনে সরকারি স্তরে খরচ কমিয়েছে, সরকারি দপ্তরে কর্মী নিয়োগ কমিয়েছে, শিল্প-কৃষিতে ভর্তুকি তুলে দিয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পাবলিক সেক্টরগুলির বিরাষ্ট্রীয়করণ করেছে। বহুজাতিক সংস্থার কাছে নিজের বাজারকে শুধু তুলে দেয় নি, তার জন্য অনুকুল পরিবেশও তৈরী করে দিয়েছে।  কিন্তু এর কাঙ্খিত ফল তারা পায় নি। বরং সমস্যাগুলি আরও বেড়েছে।

যে সমস্যাগুলিকে সামনে রেখে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি বিশ্বায়নকে স্বাগত জানিয়েছিল সেই সমস্যাগুলি নজিরবিহীন ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৮ এর রাষ্ট্রসংঘের দেওয়া একটি রিপোর্টে জানা গেছে যে উন্নয়নশীল দেশগুলির ৪.৪ বিলিয়ান জনসংখ্যার ৩/৫ অংশ মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবা পায় না, ১/৩ অংশ মানুষের বিশুদ্ধ পানীয় জল জোটে না, ১/৫ অংশ শিশুর বুনিয়াদি শিক্ষাটুকুও জোটে না। ১৫০ কোটি মানুষের দৈনিক মাথপিছু আয় ১ ডলারেরও কম (১৯৯৭ এর তথ্যানুযায়ী) অর্থাৎ এঁরা দারিদ্র্য সিমার নিচে বসবাসকারী মানুষ। দেশে দেশে আর্থিক বৈষম্য, শ্রমিক ছাঁটাই, শিশুমৃত্যুর মত ঘটনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এর থেকে সমাজে নানান রাজনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষ এমনকি ২১ শতকে দাঁড়িয়ে জাতপাত ও ধর্মের নামে হিংসা সংঘটিত হচ্ছে। মানুষের নৈতিক অধঃপতন হচ্ছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলিকে কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখে দিয়ে নিজেদের স্বার্থে দেশের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। 

তৃতীয় বিশ্বের অভিজ্ঞতা থেকে অন্তত এটা প্রমানিত হয়েছে মুক্ত অর্থনীতি অন্তত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষে স্বাস্থ্যকর হয়ন। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...