Afganistan Crisis (1973-2022) | আফগানিস্তান সংকট
মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত আফগানিস্তান প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে পূর্ণ একটি দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতিতে বৃহৎ শক্তিগুলির নজর ছিল আফগানিস্তানের উপর। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পর্ব থেকেই আফগানিস্তান ছিল দুর্বল, পশ্চাদগামী এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জীর্ণ। মহম্মদ জাহির শাহ'র হাতে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে আফগানিস্তান শাসিত হয় এবং ১৯৭৩ সালে তাঁর ইউরোপ ভ্রমণকালে এক প্রাসাদ অভভুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। তাঁরই এক আত্মীয় মুহম্মদ দাউদ খান কমিউনিস্ট পার্টি PDP (People's Democratic party) এর সহযোগিতায় ক্ষমতা দখল করেন। দাউদ আফগানিস্তানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে আফগানিস্তানে রাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান হয়।
সোভিয়েত আগ্রাসন
PDP এর দুটি গোষ্ঠী ছিল-- খাল্ক ও পারচাম। প্রথম গোষ্ঠীর নেতা ছিলে নূর মহম্মদ তারাকি ও হাফিজুল্লা আমিন এবং দ্বিতীয় গোষ্ঠীর নেতা ছিলে বারবাক কারমাল। দ্বিতীয় গোষ্ঠীই দাউদ খানকে ক্ষমতা দখলে সহযোগিতা করেছিল। নূর মহম্মদ তারাকি ছিলেন দাউদ খানের প্রধানমন্ত্রী। সোভিয়েতের প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল যে খাল্ক গোষ্ঠী আমেরিকার সাথে সংযোগ রেখে চলছে। ১৯৭৮ সালে দাউদ খান সোভিয়েত ভ্রমনে এলে এক 'ক্যু' এর মাধ্যমে নূর মহম্মদ ক্ষমতা দখল করেন। নূর মহম্মদের শাসনকালে PDP সরকারে বেশ কিছু সংস্কার কর্মসুচী ইসলামিক ভাবাবেগে আঘাত করে, যার ফলে তাঁর বিরুদ্ধে গোঁড়াপন্থী ইসলামিক সংগঠন গুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। একই রকম একটি ক্যু ঘটিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই হাফিজুল্লা আমিন নূর মহম্মদকে ক্ষমতাচ্যুত করে আফগানিস্তানের কর্ণধার হন।
হাফিজুল্লা আমিন বামপন্থী শাসক হওয়ার সত্ত্বেও ক্রমাগত তাঁর মার্কিন যোগাযোগ ও নির্ভরতা বাড়তে থাকে। এর ফলে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের চিন্তা বেড়ে যায়। ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানের প্রান্তবর্তী এলাকাগুলিতে ইসলামিক শক্তিগুলি তৎপর হয়ে উঠছিল। আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের দক্ষিণ দিকের প্রদেশগুলির কয়েকটি ছিল মুসলমান অধ্যুষ্যিত এবং মূল রুশ সংস্কৃতির থেকে এরা আলাদা ছিল। ইতিমধ্যে ১৯৭৮ সালে ইরানে ইসলামীয় বিপ্লব ঘটে গেছিল। এই প্রেক্ষিতে আফগানিস্তনের মুসলিম মৌলবাদীরা সোভিয়েতের মুসলিম প্রধান এলাকায় ঢুকে উত্তেজনা সৃষ্টির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান ব্রেজনেভ ১৯৬৫ সালে ক্ষমতায় এসে ঘোষনা করেছিলেন, যেকোনো কমিউনিষ্ট শাসিত দেশে সমাজতন্ত্র বিপন্ন হতে দেখলে সোভিয়েত ইউনিয়ন নির্দ্বিধায় সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে। এই ঘোষনা ব্রেজনেভ তত্ত্ব নামে পরিচিত।ব্রেজনেভ তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটানো হয় আফগানিস্তানে। ১৯৭৯ সালের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। আফগান শাসক হাফিজুল্লা আমিন ক্ষমতাচ্যুত হন। কট্টর মস্কোপন্থী বারবাক কারমালের হাতে আফগানিস্তানের শাসন তুলে দেওয়া হয়।
সোভিয়েত প্রভাবের অবসান
সোভিয়েত প্রভাব সেখানে বেশিদিন টিকতে পারে নি। আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানে সোভিয়েত সেনা-দখলদারির বিরুদ্ধে সশস্ত্র গেরিলা প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। বিদ্রোহী আফগান মুজাহিদরা সোভিয়েত বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে তোলে। মুজাহিদদের সহযোগিতা করতে থাকে পাকিস্তান, ইরান, চিন ও আরব। কিন্তু আমেরিকার গোপন সাহায্য তাদের পক্ষে সবথেকে বেশি লাভজনক হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে মিখাইল গরবাচভ সোভিয়েত দেশে ক্ষমতায় আসেন এবং আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর গরবাচভ সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু নতুন শাসক মনোনীত হন নাজিবুল্লাহ। ইনিও ছিলেন মস্কোপন্থী। রাজধানী কাবুল ছাড়া তাঁর ক্ষমতা কোথাও ছিল না, বাকি এলাকায় মুজাহিদদের কর্তৃত্ব ছিল। ১৯৯২ সালে মুজাহিদরা নাজিবুল্লাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। কমিউনিস্ট শাসনের অবসান হয়।
তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠা
PDP শাসনের অবসানের পর আফগানিস্তানে বিভিন্ন মুজাহিদিন গোষ্ঠীর নেতারা একটা যৌথ সরকার গঠন করে। কিন্তু তাঁরা কোনো ভাবেই ঐক্যমতে আসতে পারেনি এবং হিংসা, হানাহানি ও ধংসে মত্ত থাকে। ইতিমধ্যে ১৯৯৪ সাল নাগাদ মোল্লা মহম্মদ ওমরের নেতৃত্বে পাকিস্তানের মদত পুষ্ট তালিবান নামে এক মুজাহিদ গোষ্ঠী সামরিক ও সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ঐ বছর তারা কান্দাহার দখল করে। ১৯৯৬ সালে ওরা কাবুল দখল করে বুরহানউদ্দিন রব্বানি সরকারের পতন ঘটায় এবং প্রতিষ্ঠা করে Islamic Emirates of Afganistan. পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং UAE এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। আফগানিস্তানের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকার উপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। আল-কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেন ছিলেন মোল্লা ওমরের প্রধান সহযোগী ও উপদেষ্টা।
আমেরিকার অনুপ্রবেশ ও সংঘাত
আমেরিকার সাথে মুজাহিদিন গোষ্ঠীগুলির গোপন আঁতাতের কথা ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে। সোভিয়েত পন্থী কমিউনিষ্ট সরকারের পতন ঘটানোর জন্য আমেরিকা ইসলামিক গেরিলাদের দেদার আর্থিক ও সামরিক সাহায্য করেছিলেন। এই গোপন তথ্য ফাঁস হয়েছিল ৯/১১ সন্ত্রাসবাদি হানায় আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধংস হওয়ার পর। আরবীয় ধনকুবের লাদেন কে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনানো হয়েছিল মুজাহিদ অর্থাৎ গেরিলা যোদ্ধা সংগ্রহ, ট্রেনিং এবং যোগান দিতেন। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তে ছিল লাদেনের সংগঠন আল-কায়দার প্রধান ঘাটি। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে আমেরিকার সাথে তালিবান ও আল-কায়দার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। রাষ্ট্রসংঘ আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয় নি। এর পিছনে আমেরিকার চক্রান্ত ছিল বলে তাদের ধারণা হয়েছিল। ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে লাদেনের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক একেবারে খারাপ হয়ে যায়। আল-কায়দা কেনিয়া ও তানজানিয়ার মার্কিন দূতাবাসে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। এই অপরাধে মার্কিন প্রশাসন লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার আবেদন জানায় তালিবান সরকারের কাছে। কিন্তু মোল্লা ওমর সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। তখন আমেরিকা ১৯৯৯ সালে আফগানিস্তানে ক্ষেপনাস্ত্র হানে, রাষ্ট্রসংঘকে চাপ দিয়ে আফগানিস্তানের উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর প্রতিক্রিয়ার ঘটে ১১/০৯/২০০১ এর ঘটনা। নিউ ইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের Twin Tower এবং ওয়াশিংটনের সামরিক ক্ষেত্র পেন্টাগন সন্ত্রাসী বিমান হানায় প্রায় অর্ধেক ধবংস হয়। আল-কায়দা এর দায় স্বীকার করে। আফগানিস্তানের তালিবান শাসক যেহেতু লাদেনের আশ্রয়দাতা তাই লাদেনের খোঁজে এবং আল-কায়দা ও তালিবানদের খতম করতে আমেরিকা আফগানিস্তানে বিমান হানা শুরু করে (৭ই অক্টোবর)। আফগানিস্তান ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয় কিন্তু লাদেনকে তারা ধরতে পারেনি। আমেরিকা সেখানে নিজ পছন্দমত হামিদ কারজাইকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব দিয়ে নিজ সেনাবাহিনী মোতায়েন রেখে আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন