ঠান্ডা লড়াই কি আদর্শগত সংঘাত না রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াই?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি হিসেবে ইউরোপের তথাকথিত শক্তিশালী দেশগুলি, যেমন- ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এদের দুর্বলতার সুযোগে আপন প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে ইউরোপে দুটি পরস্পর বিরোধী শক্তি জোট গড়ে ওঠে। ফলে বিশ্বের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় এরা অবতীর্ণ হয়। তথাকথিত পরাশক্তিগুলি এখন এই দুই রাষ্ট্রের সাহায্যপ্রাপ্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও হিটলারের আক্রমণ থেকে বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য এরা একত্রে কাজ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে এদের মধ্যে মতাদর্শগত বিরোধ মাথা ছাড়া দিয়ে ওঠে। তবে এই বিরোধ ছিল প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তারের প্রতিযোগিতা, সরাসরি সংঘর্ষ নয়। বিশ্ব ইতিহাসে আমেরিকা ও সোভিয়েতের মধ্যেকার এই সংঘর্ষ ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমের রাষ্ট্র গুলিকে একত্রিত করে একটি পশ্চিমী জোট গঠন করে। অন্যদিকে আমেরিকার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় রাশিয়াও। রাশিয়া পূর্বদিকের শক্তিগুলিকে একত্রিত করে গড়ে তোলে পূর্ব শক্তি বলয়। উল্লেখ্য বিষয় এটাই যে পুঁজিবাদী মার্কিন ও সাম্যবাদী সোভিয়েত রাশিয়ার এই সংঘাত কখনোই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রূপ নেয়নি। তাই একে ঠান্ডা লড়াই বলা হয়। ঠান্ডা লড়াইয়ের ফলে সমগ্র আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সর্বদাই একটি অস্বস্থিকর পরিবেশ বিরাজ করত বলে একে অনেক ঐতিহাসিক স্নায়ুর যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। এই লড়াইয়ে বিশ্ব পূর্ব ও পশ্চিম দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে গেছিল বলে ঠান্ডা লড়াইয়ের রাজনীতিকে অনেকে আবার দ্বিমেরুর রাজনীতি বলে উল্লেখ করেছেন।
ঠান্ডা লড়াই প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন উঠে আসে যে, এই লড়াই কি মতাদর্শগত বিরোধ না রাজনৈতিক লড়াই? ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা পর্বে উভয় শক্তি এই সংঘাতকে মতাদর্শগত রূপ দিয়েছিল। উল্লেখ্য যে মতাদর্শগত বিরোধ বলতে এখানে ধনতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্র এবং সংসদীয় গণতন্ত্র বনাম একদলীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যেকার লড়াইকে বোঝানো হয়েছে। একদিকে সোভিয়েতে সাম্যবাদী সমাজতন্ত্র ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ঐতিহ্যবাহী মার্কিন ভাষ্যকাররা ঠান্ডা লড়াইয়ের আদর্শগত সংঘাতকে সামনে রেখে এই লড়াইয়ের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকেই দায়ী করেছিলেন। এদের বক্তব্যের নির্যাসটি ছিল - 'Cold war was a brave and essential response of free men to communist aggression.' তাদের মতে কমিউনিস্ট রাশিয়ার সম্প্রসারণনীতি ও আগ্রাসী ভাবভঙ্গি যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমী শক্তিগুলির গভীর চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান জানান- 'There is not any Difference in totalatorian States - Nazi , communist or Fascist or anything else - they are all alike .' জর্জ কেন্নান তার 'The American Diplomacy' গ্রন্থে জানিয়েছেন সোভিয়েত রাশিয়া সাম্যবাদ প্রসার ও পুঁজিবাদের অবরোধ করার জন্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করেছিল এবং এর ফলেই ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা।
বিংশ শতকের ষাটের দশক থেকে সংশোধনবাদী ভাষ্য জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই ধারার পথপ্রদর্শক ছিলেন The Cold War (1947)গ্রন্থের রচয়িতা ওয়াল্টার লিপম্যান। এই ধারার বিশ্লেষকগন আদর্শগত কারণের চেয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং যুদ্ধের কারণ হিসাবে, প্রধানত মার্কিনের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। ঐতিহাসিকরা প্রাথমিকভাবে বলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত স্বার্থকে ক্ষুন্ন করে সোভিয়েতকে বিব্রত করেছিলেন। 'The Origins of Cold War' গ্রন্থে ঐতিহাসিক ডি এফ ফ্লেমিং দেখিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবল সোভিয়েত রাশিয়ার সম্প্রসার প্রতিরোধের জন্যই পশ্চিমী ব্লকের সৃষ্টি করেননি। এক্ষেত্রে তার আসল ইচ্ছা ছিল যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে নেতৃত্বদান। এই উদ্দেশ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান আদর্শবাদকে তুলে ধরেন এবং সোভিয়েত বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন। এদিকে ফ্লেমিং এর সমর্থনে ঐতিহাসিক হরোউইজ বলেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং তার পক্ষে বিশ্বব্যাপী সাম্যবাদের প্রসারের পরিকল্পনা নেওয়াটা অকল্পনীয় ছিল। আসলে তিনি বলতে চেয়েছেন মার্কিন অগ্রাসীনীতির কারণেই সোভিয়েত রাশিয়া সম্প্রসারণবাদী নীতি গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল।
ঠান্ডা লড়াইয়ের সামরিক ও অর্থনৈতিক দিকটি তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিক গাব্রিয়েল কল্কো। তিনি তাঁর গ্রন্থ 'The Politics of War: The World and United States Forighn Policy' 1943-93 তে দেখিয়েছেন আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আনবিক বোমার একচেটিয়া অধিকারী হয়ে বসে। নতুন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের সমঝোতা নীতি ত্যাগ করে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেন। এছাড়াও আমেরিকা অনেক সময় বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে স্বৈরতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সরকারকে সমর্থন করে। আমেরিকার এরুপ জঙ্গি মনোভাবের প্রতিরোধে রাশিয়া এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সে বিশ্ব অর্থনীতির পরিচালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছিল। মুক্তপন্থী বাণিজ্য অর্থনীতির দ্বারা একতরফা বিশ্ব অর্থনীতিকে বেঁধে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তাঁর এই লক্ষ্য পুরোনের প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার সাম্যবাদ। তাই আমেরিকা সাম্যবাদ বিরোধী মতাদর্শ গ্রহণ করে।
সুতরাং বলা চলে যে বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন বিন্যাসের ফলশ্রুতি হিসাবে দুই মহা শক্তিধর রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল এবং এরই স্বাভাবিক পরিণতি ছিল Cold War বা স্নায়ুর যুদ্ধ। লুই জে হ্যালের কথা অনুযায়ী বলা যায়, ঠান্ডা লড়াই ছিল প্রকৃতই চিরাচরিত ক্ষমতার দ্বন্দ্বের স্বাভাবিক পুনরাবৃত্তি।
The Cold War: Is it an ideological conflict or a political struggle for expansion?
In the aftermath of World War II, the United States gathered the Western states together to form a Western block. On the other hand, Russia challenged America. Russia united the Eastern powers and created the Eastern power block. It is noteworthy that this conflict between capitalist America and socialist Soviet Russia never took the form of direct conflict. Therefore, it is called the Cold War. As a result of the Cold War, an uneasy environment prevailed in international politics. Many have referred to this war as a significant historical battle. This war divided the world into two spheres, East and West, leading some to describe the politics of the Cold War as bipolar politics.
Regarding the Cold War, a question arises: is this war an ideological conflict or a political struggle? The initiation of the Cold War by both powers portrayed it as an ideological conflict. It should be understood that ideological opposition refers to the fight between capitalism and socialism, and parliamentary democracy versus one-party rule. On one side, the Soviet Union represented socialist socialism and one-party rule, while on the other side, the United States stood as a capitalist democratic state. According to renowned American commentator George F. Kennan's book "The American Diplomacy," the expansion policy of Soviet Russia aimed to prevent the spread of communism and aggression and was the cause of deep concern for the United States and other Western powers. American President Harry Truman stated, "There is not any difference in totalitarian States - Nazi, communist or Fascist or anything else - they are all alike." George Kennan, in his book "The American Diplomacy," mentioned that Soviet Russia adopted expansion policies to counter the spread of communism and capitalism and that was the reason behind the Cold War.
From the 1960s to the 1970s, revisionist interpretations gained popularity. The Cold War, written by Walter Lippmann, was a guiding reference in this trend. The analysts of this school emphasized political and economic interests rather than ideological motivations, primarily pointing fingers at the United States as the cause of the war. Historians have initially argued that the United States, driven by its anti-Soviet agenda, crushed Soviet ambitions in Eastern Europe, thus provoking the Soviet Union. The book "The Origins of the Cold War" by D.F. Fleming supports this perspective, claiming that the United States' primary goal was to establish post-war global leadership through war. In pursuit of this objective, President Harry Truman abandoned the policy of appeasement and confronted Soviet opposition. Historical researcher Herbert Feis, in line with Fleming's support, argued that the Soviet Union suffered more significant losses in World War II and that the global spread of communism was an unrealistic plan. He suggested that Soviet expansionist policies were compelled by the United States' aggressive pre-war policies.
Gabriel Kolko highlighted the military and economic aspects of the Cold War. In his book "The Politics of War: The World and United States Foreign Policy" 1943-93, he demonstrated that America emerged as the dominant nuclear power after World War II. The new American president, Truman, discarded his predecessor Roosevelt's policy of understanding and adopted an assertive policy. Additionally, the United States often supported dictatorial and socialist governments in various countries worldwide to counter the militant mindset of Russia. Russia felt compelled to surpass the aggressive American attitude. After World War II, America transformed into the most potent economic force globally. It aimed to utilize this economic prosperity to play a guiding role in global economics. It attempted to bind the world's economic policy through liberal capitalism. However, the primary obstacle to achieving this goal was Soviet socialism. Therefore, America adopted an anti-socialist stance.
Consequently, it can be said that the aftermath of World War II witnessed the emergence of two major powers, resulting in a new formation in world politics known as the Cold War. As Louis J. Halle stated, the Cold War was an inevitable recurrence of the enduring rivalry between great powers.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন