সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

Annals School

Annals School

Annals School হল ফরাসি ইতিহাসবিদদের একটি গোষ্ঠী, যারা ২০ শতকের গোড়ার দিকে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং ইতিহাস চর্চার পদ্ধতিতে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। এই গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা স্ট্রাসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক মার্ক ব্লক এবং লুসিয়েন ফেব্রে। উভয়ের দ্বারা ১৯২৯ খ্রীঃ  প্রকাশিত পত্রিকার নাম ছিল Annals of Economic and Social History (সংক্ষেপে Annals)। এই পত্রিকা থেকেই উক্ত ঐতিহাসিকদের গোষ্ঠীর নাম হয়েছিল  Annals School.  এই গোষ্ঠী ইতিহাস লেখার ঐতিহ্যগত পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, যা রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত এবং ইতিহাসের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক দিকগুলিকে উপেক্ষা করত। পরিবর্তে, তারা একটি নতুন পদ্ধতির পক্ষে সওয়াল করেছিল যেখানে তৃনমূল স্তরের মানুষের জীবনের দিনগত বিশ্লেষণ, জনতার মানসিকতা ও ক্রিয়াকলাপের প্রতিচ্ছবিকে পুঁজি করে ইতিহাসের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অ্যানালস স্কুলের মূল নীতিগুলির মধ্যে একটি ছিল দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা এবং কাঠামো অধ্যয়নের গুরুত্ব। তারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন ঘটনার একটি সিরিজ হিসাবে দেখা উচিত নয়, বরং পরিবর্তন এবং বিকাশের একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা উচিত। এই পদ্ধতির প্রতিফলন ঘটেছে তাদের বিখ্যাত উক্তিতে: "la longue durée" বা "দীর্ঘ মেয়াদী।"  অ্যানালস স্কুল ঐতিহাসিক ঘটনাবলী গঠনে ভূগোল এবং পরিবেশের ভূমিকার উপরও জোর দিয়েছে। তারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে জলবায়ু, ভূখণ্ড এবং প্রাকৃতিক সম্পদের মতো ভৌগোলিক এবং পরিবেশগত কারণগুলি ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মার্ক ব্লক এবং লুসিয়েন ফেব্রের অনেক আগেই ১৯৩০-এ হেনরি বের Review of Historical Synthesis নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল সমাজের অন্তর্বর্তী মানুষের সবরকমের ক্রিয়াকলাপ বিশ্লেষণ করা। এই উদ্দেশ্যে তিনি Evalution of Humanity নামে ১০০ খণ্ডে বিভক্ত একটি গ্রন্থমালা প্রকাশ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। সুতরাং হেনরি বের ছিলেন Annals School পথপ্রদর্শক। 

এবার আনালস স্কুলের কয়েকজন ইতিহাসবিদ ও তাদের ইতিহাসচর্চা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। আনালস স্কুলের প্রথম দিকের ঐতিহাসিক লুসিয়েন ফেব্রে-র অন্যতম গ্রন্থ Martin Luther, যেখানে তিনি লুথারের জীবনবৃত্তান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের সামাজিক ইতিহাস এবং তখনকার মানুষ ও গোষ্ঠীর মধ্যে যোগসূত্র অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন।  The Island of France গ্রন্থে মার্ক ব্লখ বিবৃত করেছেন এ স্থানের ভাষা, জমির চরিত্র, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ এবং স্থাপত্য। The Royal Touch গ্রন্থে ব্লখ দেখিয়েছেন কিভাবে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের দৈব ক্ষমতায় সাধারন মানুষের বিশ্বাস (রাজার ছোঁয়ায় রোগ সেরে যায়) রাজতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে সাহায্য করেছিল। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ Feudal Society. এখানে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ততকালীন মানবসমাজের মানসিকতা কাঠামোগতভাবে সামন্ততান্ত্রিক দুনিয়াকে ধারন করে রেখেছে। 

মার্ক ব্লক এবং লুসিয়েন ফেব্রে ছাড়াও, অ্যানালস স্কুল আরও অনেক প্রভাবশালী ইতিহাসবিদ তৈরি করেছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে একজন ছিলেন ফার্নান্ড ব্রদেল, যিনি অ্যানালস স্কুলের ধারণাগুলিকে প্রসারিত করেছিলেন এবং "বিশ্বের ইতিহাস" এর নিজস্ব ধারণা তৈরি করেছিলেন। ব্রদেল যুক্তি দিয়েছিলেন যে ইতিহাসকে একাধিক স্তরে অধ্যয়ন করা উচিত-- ব্যক্তি থেকে বিশ্বব্যাপী স্তর পর্যন্ত, এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোগুলিই ছিল ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মূল চালক। তাঁর বক্তব্য, মানুষ তাঁর পরিপার্শ্বিক ভৌগলিক অবস্থান ও সময়ের উপর ছাপ রেখে যায় আবার বিপরীতে বিরাট সামাজিক কাঠামো মনুষ্যচালিত রাজনীতি এবং বৌদ্ধিক ঘটনাবলীকে ঠেকানোর চেষ্টা করে। তার মতে, বাস্তবে সমাজে তিনটি স্তর থাকে, প্রথম এবং মূল স্তরটিতে পরিব্যপ্ত থাকে ভৌগোলিক পরিবেশ প্রাকৃতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে নিয়ামক উপাদানগুলি। দ্বিতীয় স্তর সংগঠিত করে দীর্ঘ সময়কালব্যাপ্ত এক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো। তৃতীয় বা সর্বোচ্চ স্তরে দেখা যায় ক্রমান্বয়ে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক এবং অন্যান্য ঘটনার সমাবেশ। এই তিনটি স্তরের মধ্যে একটা পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। তাঁর The Mediterrenean and the Mediterrenean World in the Age of Philip II গ্রন্থে তিনি একটি গ্লোবাল পরিধির কাঠামোতে সম্রাট ফিলিপের স্পেনীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাস লিখেছেন। 

অ্যানালস স্কুলের আরেকজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন ইমানুয়েল লাদুরি, যিনি ফ্রান্সের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি তার বই "Montaillou" এর জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত, যেখানে একটি মধ্যযুগীয় ফরাসি গ্রামের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবন এবং বিশ্বাসকে তুলে ধরা হয়েছে জন্য একটি ইনকুইজিশন ট্রায়ালের রেকর্ড ব্যবহার করে। The Peasants of the Languedoc গ্রন্থে তিনি দেখালেন কিভাবে কৃষক সমাজ পরিবরতনশীল অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। 

নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং ভূগোলের মতো অন্যান্য শাখায়ও অ্যানালস স্কুলের উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। ইতিহাসের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে ব্যবধান দূর করতে সাহায্য করেছে এবং পণ্ডিতদের আরও আন্তঃবিভাগীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছে।

উপসংহারে, ইতিহাস লেখা ও বোঝার পদ্ধতিতে অ্যানালস স্কুল বিপ্লব ঘটিয়েছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা এবং কাঠামো, ভূগোল এবং পরিবেশ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলির গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছে। আনালস স্কুলের ইতিহাস চর্চা নিরিন্তর ইতিহাসবিদ্যাকে পরিপুষ্ট করেছে এবং সমাজ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ