সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কোম্পানির শাসনে ভারতে পুলিশ ব্যবস্থার বিকাশ | Indian Police under the Company Rule

কোম্পানির শাসনে ভারতে পুলিশ ব্যবস্থার বিকাশ 

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অন্যতম স্তম্ভ ছিল পুলিশ বিভাগ। পুলিশের প্রাথমিক কাজ ছিল ইংরেজ অধিকৃত অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা তথা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা যে কোন ধরনের প্রতিবাদ আন্দোলনকে প্রতিহত করা।

প্রাথমিক ব্যবস্থা ও হেস্টিংস-এর সংস্কার

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানির অধিকার পায়। তখন মুঘল পুলিশ ব্যবস্থা ফৌজদারদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। প্রতিটি সরকার বা জেলা তাদের অধীনে থাকত। কোতোয়ালরা থাকতেন শহরগুলি দেখভালের দায়িত্বে। গ্রামের চৌকিদারদের নিয়ন্ত্রণ করতেন জমিদাররা। মুর্শিদাবাদের নায়েব নাজিম রেজা খাঁর তদারকিতে এই পুরনো ব্যবস্থাই বেশ কিছুদিন কোম্পানি চালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ১৭৭০ এর দুর্ভিক্ষের পর আইনশৃঙ্খলাজনিত অবনতির প্রেক্ষাপটে কোম্পানি সরকার পুলিশ বিভাগীয় প্রশাসনকে ইউরোপীয় তদারকির অধীনে আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ইতি মধ্যে দ্বৈত শাসনের অবসান হয়। ১৭৮১ পর্যন্ত এই পুরানো ফৌজদারী ব্যবস্থায়ই চলেছিল। ওয়ারেন হেস্টিংস তাতে সামান্য কিছু সংস্কার এনেছিলেন। তিনি ফৌজদারদের সরিয়ে তাদের জায়গায় ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটদের এনেছিলেন। জমিদারদের আরক্ষার কাজ তখনো বজায় ছিল।

কর্নোয়ালিসের সংস্কার

হেস্টিংস এর সংস্কার বিশেষ ফলপ্রসু হয়নি। কারণ জমিদারেরা এই ব্যবস্থার অপব্যবহার করতেই থাকে। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশ জমিদারদের থেকে আরক্ষার কাজের দায়িত্ব কেড়ে নেন। তিনি জেলাগুলিকে কতকগুলি থানার অধীনে ভাগ করেন। ২০ থেকে ৩০ বর্গমাইল পর্যন্ত এলাকায় থাকত এক একটি থানার আরক্ষার কাজের এক্তিয়ার। প্রতি থানার দায়িত্বভার দেওয়া হয় একজন নতুন আধিকারিক, দারোগার উপর। তাদের কাজের দেখভাল করতেন ম্যাজিস্ট্রেটরা। দারগাদের পক্ষে পল্লীগ্রামের প্রতাপশালী ও ধনী ভূস্বামীদের এড়িয়ে চলা সম্ভব ছিল না; কারণ তারা গ্রামে ছিলেন নতুন ও বহিরাগত। দারগাদের অবস্থা তখন সবচেয়ে খারাপ হত, যখন গ্রামের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জমিদার ও নীলকর লড়াই হত। এই ভয়াবহ লড়াই আটকানোর মত সাজসরঞ্জাম হতভাগ্য দারোগাদের প্রায় ছিল না বললেই চলে। নীরব দর্শক হয়ে থাকতে হত।

কালেক্টরদের হাতে ক্ষমতা প্রদান

বাংলার বাইরে ভারতের অন্যত্র তহশীলদারি ব্যবস্থা চালু ছিল। কিন্তু প্রত্যেক জায়গাতেই তহশীলদারি ব্যবস্থার পরিণাম ভয়াবহ হয়েছিল। টমাস মনরো এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে এই ব্যবস্থা এ দেশের প্রচলিত দেশাচারের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। এই ব্যবস্থার ব্যর্থতার জন্য এদেশীয় অধস্থন আধিকারিকদের নৈতিকতা ও একাগ্রতার অভাবের দিকে আঙুল তোলা হয়। কর্নওয়ালিস এর ব্যবস্থাকেও বাতিল করা হয়। ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে তহশিলদারদের কাছ থেকে পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের দারোগা ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে উঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন থেকে গ্রামের আরক্ষা ব্যবস্থা তদারকি দায়িত্ব দেওয়া হয় কালেক্টরকে। এরপর থেকে তিনি একসঙ্গে রাজস্ব, আরক্ষা ও শাসন বিভাগীয় কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন। কালেক্টরদের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা চলে যাওয়ার ফলে গ্রামগঞ্জে রাজস্ব বিভাগের অধঃস্তন কর্মচারীদের দমনপীড়ন ও জুলুমবাজি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে নিযুক্ত মাদ্রাজ নিগ্রহ আয়োগের টর্চার কমিশনের প্রতিবেদনে এই দমনপীড়নের কথা প্রকাশ পেয়েছিল। আবার বাংলার ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে কালেক্টারের দপ্তরে অধ:স্থন কর্মীর কোনো সংস্থান ছিল না। তাই সেখানে দারোগা ব্যবস্থাই রেখে দেওয়া হয়েছিল।

চার্লস নেপিয়ারের ব্যবস্থা

১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু জয়ের পর চার্লস নেপিয়ার সেখানে এক নতুন পুলিশ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন, যাতে ভারতীয়দের কার্যত পুরোপুরি এই ব্যবস্থা থেকে বাতিল করা হয়। আইরিশ পুলিশ ব্যবস্থার ধাঁচে গড়ে তোলা এই ব্যবস্থায় সমগ্র এলাকাকে একজন ইন্সপেক্টর জেনারেলের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। প্রতিটি জেলায় থাকত একজন করে সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ। পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট আবার ইন্সপেক্টর জেনারেল এবং জেলা কালেক্টর এর কাছে জবাবদিহি করতেন। জেলা কালেক্টরদের হাতে থাকত  অসামরিক প্রশাসনিক কর্তৃত্ব। পুলিশ বাহিনীর সাধারণ সেনারা ছিলেন ভারতীয়। তাদের মাথার উপর সব আধিকারিক হতেন ইউরোপীয়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে এই নতুন ব্যবস্থা চালু হয় নব অধিকৃত পাঞ্জাবে। তারপর কিছু রদবদল ঘটিয়ে এই ব্যবস্থা ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইতে চালু হয়। মাদ্রাজে চালু হয় ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে।

ইতিমধ্যে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দেয়। ব্রিটিশ কর্তারা উপলব্ধি করেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ধরে রাখার জন্য দরকার আরো দক্ষ ও আরো কার্যকর পুলিশ ব্যবস্থা। তার জন্য ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ কমিশনার নিয়োগ করা হয় এবং ১৮৬১ তে রচিত হয় পুলিশ আইন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক