সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

১৮৯৮ এর সংস্কার | Hundred days' Reform

১৮৯৮ এর সংস্কার | Hundred days' Reform

১৮৯৮ সালে চীনে মাঞ্চু শাসক গুয়াংশুর রাজত্বকালে যে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার সাধিত হয় তা শত দিবসের সংস্কার নামে পরিচিত। উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে চীনে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তা এক সংস্কারকামী জনমত গঠন করেছিল। যদিও এই জনমত ছিল বুর্জোয়া জনমত। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কাং ইউ ওয়েই। জনমতের চাপে পড়ে সম্রাট গুয়াংশি সংস্কার সাধন করলেও পরবর্তীকালে রক্ষণশীলদের চাপে তা ব্যর্থ হয় এবং সম্রাটের পদচ্যুতি হয়। মাত্র ১০০ দিন স্থায়ী এই সংস্কার শত দিবসের সংস্কার নামে পরিচিত।

উনিশ শতকের শেষ দশকে চীনে বেশ কিছু দেশীয় শিল্প গড়ে উঠেছিল। ফলে চীনে একটি শিল্পপতি বুর্জোয়া শ্রেণীর উত্থান ঘটছিল। অন্যদিকে আবার শিল্পাশ্রয়ী সর্বহারার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ইতিমধ্যে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানের হাতে চীনের শোচনীয় পরাজয় এবং মর্যাদাহানি চীনের শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে নতুন ভাবনা চিন্তার উদয় ঘটিয়েছিল। এই সব দেশপ্রেমিকদের অধিকাংশই ছিলেন ছাত্র, বিশেষ করে যারা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সান ইয়াৎ সেন, যিনি মাঞ্চুদের ক্ষমতাচ্যুত করার একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ব্যর্থ হয়ে জাপানে পলায়ন করেছিলেন। এমত অবস্থায় চীনের সম্পদশালী ও পুঁজিপতি শ্রেণীর আলোকপ্রাপ্ত অংশ মাঞ্চুবিরোধী কোনও রাজনৈতিক অভ্যুত্থানে না জড়িয়ে সংস্কার সাধনের মাধ্যমে চীনকে সাম্রাজ্যবাদী বিভাজনের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

সংস্কার আন্দোলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন কাং ইউ ওয়েই। তিনি ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা মে ১৩০০ জন বুদ্ধিজীবী স্বাক্ষর সমেত একটি প্রতিবেদন চীনের রাজদরবারে পাঠিয়েছিলেন। এই প্রতিবেদনে শিমোনোসেকির চুক্তি অনুমোদন করতে সম্রাটকে নিষেধ করা ছাড়াও রাজধানী পিকিং থেকে সিয়ানে স্থানান্তর, আর্থিক, ব্যাংক ব্যবস্থা ও ডাক ব্যবস্থার সংস্কার, ব্যক্তিগত উদ্যোগে আধুনিক শিল্প গড়ে তোলার বিষয়ে সরকারি সাহায্য, আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও কৃষিবিদ্যার পঠন পাঠন, পরীক্ষা সংস্কার প্রভৃতি বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল। সম্রাট এর কাছে প্রেরিত তার পর পর চারটি প্রতিবেদন কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। ইতিমধ্যে কাং এর মতাদর্শের পক্ষে চিনে জনমত গড়ে উঠতে থাকে। বিভিন্ন পাঠচক্র গড়ে ওঠে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবিষয়ে আলোচনা করে, যেগুলি চীনে একটি সংস্কারমুখী আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য সংস্কারপন্থীরা গণতন্ত্রের পক্ষে সওয়াল করেননি, তারা একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন।

১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে কাং তার পঞ্চম প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। ওই বছর ১১ জুন গুয়াংশু Decision on National Affairs নামে একটি রাজকীয় আদেশ জারি করেন এবং সংস্কার সাধনের কথা ঘোষণা করেন। সম্রাটকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে গুয়াংশুর বালক বয়সের শিক্ষক ওয়েং টুং হি-র ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সম্রাট এবার সংস্কারপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল করেন। কাং ছাড়াও ছিলেন তান শি-টং, হুয়াং জুন শিয়ান, লিয়াং চি চাও প্রমুখ। একাধিক রাজকীয় নির্দেশনামার মাধ্যমে শাসন, শিক্ষা এবং অর্থনীতিতে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধিত হয়। অপ্রয়োজনীয় এবং কর্মভারহীন পদ ও অফিসগুলি তুলে দেওয়া হয়। সমস্ত মাঞ্চুদের যে আর্থিক অনুদান দেওয়া হত তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যয়বহুল গ্রিন স্ট্যান্ডার্ড বাহিনীকে অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা করে বাতিল করে দেওয়া হয়। পুরাতন ও অব্যাবহৃত ধর্মস্থান ও মন্দিরগুলিকে এক একটি বিদ্যালয়ের পরিণত করা হয়। এই সময়েই পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বিজ্ঞান ও রাজনীতিকে আবশ্যিক করা হয়। পরীক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটানো হয়। গবেষণা এবং সৃজনমূলক আবিষ্কারকে উৎসাহ দেয়ার জন্য গবেষকদের পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়। একটি অনুবাদ কমিটি গঠিত হয়। যাবতীয় বিদেশী গ্রন্থ অনুবাদ করার দায়িত্ব এই কমিটির উপর দেওয়া হয়। পাঠচক্র গড়ে তোলা এবং আধুনিকতার সমর্থনে সংবাদপত্র প্রকাশ করার ঢালাও সরকারি অনুমোদন দেয়া হয়। সংস্কারপন্থীরা সরকারি বাজেট তৈরি করার দিকেও নজর দেয়। সরকারের আয়ব্যয়ের হিসাব এবং আর্থিক নীতি সম্পর্কে জনসাধারণকে অবগত করার দিকেও দৃষ্টি দেওয়া হয়। দুটি পৃথক মন্ত্রণালয় এবং দপ্তর চিনে খোলা হয়। একটি দপ্তর পেল রেলপথ নির্মাণ এবং খনি খনন সংক্রান্ত বিষয়গুলি তদারকি করার দায়িত্ব। দ্বিতীয়টি কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলি দেখাশোনা করার দায়িত্ব পায়। এই প্রথম চীনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অস্ত্রকারখানা গড়ে তোলার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়।

সংস্কার বিরোধীরা অবশ্য চুপচাপ ছিল না। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিধবা রাজমাতা জু সি। তিনি তার রং লু বাহিনীর সাহায্যে গুয়াংশুকে সিংহাসন চ্যুত করে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। সম্রাট তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং ইউয়ান সি কাই নামক জনৈক্য সামরিক নেতার সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন। ইউয়ান বিশ্বাসঘাতকতা করলেন এবং সম্রাটের সিংহাসন 
চ্যুতি ঘটল। সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংস্কারপন্থীদের কঠোর হাতে দমন করা হল। পাঁচজন সংস্কারপন্থী নেতাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল।  কাং ও লিয়াং বিদেশে পলায়ন করলেন। যদিও সংস্কারপন্থীদের পক্ষে তীব্র জনমত গড়ে উঠেছিল এবং এই ভয়েই গুয়াংশিকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত থেকে রাজমাতা পিছিয়ে এলেন। এই ভাবেই চীনে শত দিবসের সংস্কারের অবসান ঘটলো।

ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা এবং রক্ষণশীলদের দমন নীতি সংস্কার আন্দোলনের ব্যর্থতার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল একথা অনস্বীকার্য। সংস্কারপন্থীরা জনগণের সহানুভূতি লাভ করেছিল এ কথাও সত্য। তবে সংস্কারপন্থীরা কৃষিপ্রধান চীনে কৃষির গুরুত্বের কথা উপলব্ধি করতে পারেনি। তাদের সংস্কার পরিকল্পনায় কৃষি সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে জনসমর্থন গণবিপ্লবে পরিণত হতে পারেনি। জনসমর্থনের বিরাট অভাবই সংস্কারপন্থীদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...