রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত
বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর থেকে কোম্পানী সরকার ভারতের অন্যান্য এলাকায় এর প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে এবং বম্বে প্রেসিডেন্সিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রসারের ক্ষেত্রে কতগুলি সমস্যা সামনে আসে, যার ফলস্বরূপ ওই দুই প্রেসিডেন্সিতে নতুন এক ভূমি বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়, যা রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত নামে পরিচিত।
মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ক্ষেত্রে প্রথমে (উনিশ শতকের প্রথম দিকে) স্থানীয় পলিগারদের জমিদার বলে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সাথেই বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। আর যেখানে পলিগারদের পাওয়া যায়নি সেখানে কয়েকটি গ্রামের এক একটি খামার গঠন করে সর্বোচ্চ নিলাম দাতাকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পরেই কোম্পানি সরকার উপলব্ধি করে যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমি থেকে আয় বৃদ্ধির আর সম্ভাবনা থাকে না। দ্বিতীয়ত, প্রভাবশালী ও ক্ষমতালোভি পলিগারদের দমন করা দরকার, কারণ এরা বারবার বিদ্রোহ করে। এর চেয়ে ছোট ছোট কৃষক ভূস্বামীদের বশীভূত রাখা সহজ। তৃতীয়ত, ডেভিড রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্ব এই সময় ব্রিটিশ প্রশাসকদের একাংশকে প্রভাবিত করেছিল। তার মতে জমিতে শ্রম ও উৎপাদন ব্যয় বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে তা উদ্বৃত্ত উৎপাদন এবং এই উদ্বৃত্ত উৎপাদনই হলো খাজনা। কিন্তু নিছক মালিকানার জোরে একদল মধ্যস্বত্বভোগী উদ্বৃত্ত উৎপাদনে ভাগ বসিয়ে, হয় সরকারের প্রাপ্য কমায় অথবা কৃষকের প্রাপ্য কমায়। জমিদার বা মালিক শ্রেণির অস্তিত্ব না থাকলে কৃষক ও সরকার উভয়ই ন্যায্য লাভ পেতে পারে।
রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রথম শুরু করেন বড়মহল অঞ্চলে আলেকজান্ডার রিড। তারপর টমাস মনরো, যিনি প্রথমে জেলা কালেক্টর ছিলেন এবং পরে মাদ্রাজের গভর্নর হয়েছিলেন। রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের মূল কথা হলো কৃষক বা রায়তের সাথে সরাসরি বন্দোবস্ত। এই ব্যবস্থায় কৃষকের হাতেই জমির মালিকানা অর্পিত হয়। স্থির হয়, জমি জরিপ করে জমিভিত্তিক রাজস্ব নির্ধারিত হবে। তারপর রায়ত বা চাষী সরকারের সাথে একটি চুক্তি করবে। বিনিময়ে কৃষক একটি পাট্টা পাবে, যা হবে জমির উপর রায়তের ব্যক্তিগত অধিকারের সরকারি স্বীকৃতি। কোনো জমির জন্য কৃষক চুক্তিবদ্ধ হতে না চাইলে উক্ত জমি পতিত হিসাবে পড়ে থাকবে। ১৮৬০ সালে মনরো স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত সম্প্রসারণের কাজে শৈথিল্য দেখা দেয়। ১৮২০ সালে মাদ্রাজের গভর্নর হয়ে তিনি আবার ফিরে আসলে আবার নতুন উদ্যম দেখা দেয়। কোম্পানির উচ্চ কর্তৃপক্ষ মনরোর প্রস্তাব ও যুক্তিতে সায় দিয়েছিল, কারণ এতে সরকারের আয় বৃদ্ধি পেত এবং জমির ওপর সরকারের কর্তৃত্ব অব্যাহত থাকত। চিরস্থায়ী ব্যবস্থায় এই দুটি অধিকারই কোম্পানি সরকার হারিয়েছিল।
রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের আরো একটি ক্ষেত্র ছিল বোম্বাই। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে গুজরাট দখলের পর এই নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল।। এ প্রসঙ্গে যে ব্যক্তির নাম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন মাউন্টস্টুয়ার্ট এলফিনস্টোন। প্রথমে দেশমুখ ও গ্রামপ্রধান পাতিলদের রাজস্ব আদায়ের অধিকার একেবারে খর্ব না করে গ্রাম সমাজে রায়তওয়ারি ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রয়াস আশানুরূপ ফল দিতে পারিনি। ধনী পাতিলদের নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ অব্যাহত ছিল। তাই শেষ পর্যন্ত পাতিলদের মধ্যস্থতাকে বাতিল করে ১৮১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় শুরু হয়।
মাদ্রাজ ও বোম্বাইতে রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত প্রাথমিকভাবে কোম্পানীর লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হয়েছিল। জমিদার বা পলিগার জাতীয় মধ্যসত্ত্বভোগীদের না থাকায় কৃষকরাও খুশি হয়েছিল। কৃষক জমির মালিকানা পেলেও চূড়ান্ত কর্তৃত্ব কিন্তু সরকারের হাতেই থাকতো। তাই কৃষক শোষণ বা প্রজা উৎখাত ঘটনা বন্ধ হয়ে যায়নি। সরকার ভূমি রাজস্বকে খাজনা বলার পরিবর্তে ভাড়া বলে উল্লেখ করেছিল যা প্রকৃতপক্ষে জমির উপর কৃষকের চিরাচরিত ভূমিস্বত্বের দাবি দুর্বল করেছিল।
দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ এলাকাতেই রাজস্বের হার ছিল অস্বাভাবিক বেশি। উৎপাদনের 1/2 অংশ রাজস্ব দিতে হতো। অন্য কোনো প্রাকৃতিক কারণে ফসল নষ্ট হলেও তাতে খাজনা মকুব হত না। পরবর্তীকালে খাজনার হার কমিয়ে এক-তৃতীয়াংশ করা হলেও তা যথেষ্টই বেশি ছিল।
তৃতীয়ত, জমি জরিপ করার কথা বলা হলেও বাস্তবে সর্বক্ষেত্রে জমি জরিপ করা হয়নি। অনেক জায়গায় খেয়াল খুশিমতো রায়তদের খাজনা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হতো। এই ব্যবস্থা পুটকাট ব্যবস্থা, যাতে কৃষকদের দেয় রাজস্ব তার গোটা খামারের উপর ধার্য করা হত। শুধুমাত্র তার জমির উপর নয়, এর ফলে সেচযুক্ত ও সেচহীন জমির উৎপাদন ক্ষমতার তারতম্য গুরুত্ব পেত না।
চতুর্থত, ডেভিড লাডেন দেখিয়েছেন যে রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় মধ্যস্তরীয় গোষ্ঠীর প্রভাবকে অস্বীকার করা হলেও তা বিলোপ করা সম্ভব হয়নি। ভারতের গ্রাম সমাজে ব্রাহ্মণদের জাতিগত প্রাধান্য এবং সুবিধাভোগীবি মিরাশিদারদের পরম্পরাগত কৃষি প্রাধান্য অব্যাহত ছিল। মিরাসিদারদের সামাজিক গুরুত্বকে কোম্পানী অবহেলা করতে চাইনি এবং নিচু তলার সরকারি পদগুলিতে এরাই অগ্রাধিকার পেত। ফলে কৃষকের উপর নির্যাতনের সম্ভাবনাগুলো থেকেই যেত।
পঞ্চমত, শস্যের পরিবর্তে নগদ মুদ্রায় রাজস্ব প্রদানের নিয়ম কৃষকদের পক্ষে বিপদজনক হয়েছিল। কোম্পানি রুপোর মুদ্রায় খাজনা আদায় শুরু করলে কৃষকরা বিপদে পড়েছিল। দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত স্টার প্যাগোডা মুদ্রার দাম রুপোর মুদ্রার থেকে ছিল কম। তাই রুপোর মুদ্রা সংগ্রহ করতে বেশি খরচ করতে হতো।
মাদ্রাজের মতো বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতেও রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত ত্রুটিমুক্ত ছিল না। রাজস্বের অত্যাধিক চড়া হার মেটাতে গিয়ে কৃষকরা প্রায় সর্বস্ব হারাতো, শোষণ অনাহারে জর্জরিত হয়ে তারা মাঝে মাঝে গ্রাম ছেড়ে নতুন এলাকায় নতুনভাবে বাঁচার চেষ্টা চালাতে বাধ্য হত। জি উইসেট ও এইচ স্মিথ রাজস্ব নির্ধারণ ব্যবস্থা্র ত্রুটি দূর করার উদ্দেশ্যে নতুনভাবে একটি সমীক্ষা চালান। এই সমীক্ষা বোম্বাই সমীক্ষা পদ্ধতি নামে পরিচিত। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে নতুন রাজস্ব নীতি চালু হয়েছিল এবং নতুন ব্যবস্থায় কৃষকদের উপর পাওনার বোঝা খানিকটা কমেছিল।। বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের সামাজিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রবীন্দ্র কুমার দেখিয়েছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন