পাবনা বিদ্রোহ | Pabna Rebellion
১৮৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দে পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহাকুমাতে এক জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয় এই বিদ্রোহ পাবনা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। একসময় সিরাজগঞ্জ ছিল নাটোরের রাজ পরিবারের জমিদারির অধীনে। কিন্তু রাজস্ব সংক্রান্ত বিরোধের কারণে ১৮৬০ এর দশকে এই জমিদারি নিলামে ওঠে এবং মুৎসুদ্দি শ্রেণীর হাতে চলে যায়। সিরাজগঞ্জ মহাকুমার শাসক পি. নোলান তার প্রতিবেদনে লিখেছেন, সিরাজগঞ্জের জমিদাররা ছিলেন অত্যধিক সক্রিয় ও উদ্যমশীল। চাষবাসের উন্নতির কাজে এরা কোনরূপ সক্রিয়তা দেখাত না; কিন্তু অসঙ্গত ও অবৈধ উপায়ে কৃষকদের শোষণ ও জমিচ্যুত করার কাজে তারা ছিল সুকৌশলী। বিভিন্ন অবৈধ কর বা আবওয়াব, যেমন পার্বণী, তীর্থ কর, সেলামি, ডাক খরচা, বিবাহ খরচা, নজরানা ইত্যাদি আদায় করত। এমনকি জমি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রেও এরা কৃষকদের ঠকিয়েছিল। যে নল ব্যবহার করে তারা নাটোরের জমিদারের কাছ থেকে সিরাজগঞ্জের জমিদারি কিনেছিল তার মাপ ছিল ২৩ থেকে পৌনে ২৪ ইঞ্চি। কিন্তু কৃষকদের বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে যে নল ব্যবহার করা হয়েছিল তার মাপ ছিল মাত্র ১৮ ইঞ্চি। অর্থাৎ কৃষকের জমি কমে গেল কিন্তু খাজনার চাপ বেড়ে গেল।
ইতিমধ্যে সরকার রোড সেস আইন জারি করে পথ কর রিটার্নের পাশাপাশি প্রজার জমিজমার পরিমাপ জানাতে নির্দেশ দেয়। তখন জমিদাররা প্ৰজার মুখ বন্ধ করার জন্য একটি স্বীকৃতি পত্র স্বাক্ষর করানোর উদ্যোগ নেয়, যাতে লেখা থাকে যে, সকল প্রকার কর কৃষকরা স্বেচ্ছায় দিচ্ছে এবং জমিদাররা কোনো নতুন কর আরোপ করলে তারা তা স্বেচ্ছায় দেবে এবং অন্যথায় তারা জমিচ্যুত হবে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কৃষক সমাজ উত্তাল হয়ে ওঠে এবং তারা আদালতের দ্বারস্থ হয়। নিম্ন আদালতে জমিদাররা জয়লাভ করলেও আপিল আদালতে জমিদাররা পরাজিত হয়। এবং তারা অতিরিক্ত খাজনা না আদায় করার অঙ্গীকার করেন।
জমিদারদের অত্যাচারের এক কৃষক সাক্ষীকে অপহরণ করা হয় এবং দীর্ঘদিন পর তার খোঁজ পাওয়া যায়। কৃষকরা জমিদারি শোষণ ও এই অপহরণের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত এই দাবি বিদ্রোহে পরিণত হয়। নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন দৌলতপুর গ্রামের জনৈক্য ক্ষুদ্র ভূস্বামী ঈশান চন্দ্র রায় এবং তার প্রধান সহকারী গঙ্গাচরণ পাল। বিদ্রোহী কৃষকরা জমিদারদের কুঠিবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। বহু জমিদার গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। অনেকেই অতিরিক্ত সেলামি দিয়ে শুধু গ্রামে থাকার সুযোগ পায়। জমিদাররা সরকারের দ্বারস্ত হয় এবং শেষ পর্যন্ত সরকার পুলিশ ও সামরিক বাহিনী দিয়ে বিদ্রোহ দমন করে(১৭৭৩)। বিদ্রোহী কৃষকদের এবং কৃষক নেতা ঈশান চন্দ্র রায় দু বছরের কারাদন্ডে দণ্ডিত হন।
পাবনা বিদ্রোহ দমন করা হলেও এই বিদ্রোহ কৃষক কৃষকদের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল উইলিয়াম হান্টার তার স্ট্যাটিসটিক্যাল একাউন্স অফ বেঙ্গল এর মুখ বন্দে এই বিদ্রোহকে কৃষি বিপ্লবের সমতল বলে উল্লেখ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এই বিদ্রোহ থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করে। এবং এই প্রথম কৃষকরা কৃষক সমিতি গঠন করে, যাকে পরবর্তীকালের কিষান সভার অগ্রদূত বলা যেতে পারে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন