ভারতীয় জাতীয়তাবাদ: সাবালটার্ন ইতিহাসচর্চা | Indian Nationalism: Subaltern Historiography
স্বাধীন ভারতের বেশকিছু ঐতিহাসিক যারা মার্কসীয় তত্ত্বকে সরাসরি গ্রহণ না করলেও মার্কসীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতিকে প্রয়োগ করে ইতিহাসের বিষয়বস্তুকে জড়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এরা ইতালির কমিউনিস্ট নেতা এন্টানিও গ্রামশিকে অনুসরণ করেছেন। ভারতীয় সমাজের যে মানব গোষ্ঠী গতানুগতিক ইতিহাস চিন্তার পর্দায় প্রতিফলিত হয়নি তারাই এই নতুন ধারার ইতিহাস চর্চার প্রধান বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই নতুন ধারার ইতিহাস চর্চার নাম হল ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ বা Subaltern Studies । নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চায় মূল ধারার রাজনৈতিক ইতিহাসের চেয়ে অধিক গুরুত্ব পেয়েছে সাধারণ দরিদ্র মানুষের জীবনের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার কথা।
বিংশ শতকের আট-এর দশকে নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার সূচনা হয় অধ্যাপক রনজিৎ গুহ সম্পাদিত 'সাবালটার্ন স্টাডিজ' প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। অধ্যাপক গুহ জোরের সঙ্গেই বলেছিলেন উপনিবেশিক ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের উত্থানের ইতিহাসকে শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ক্রিয়া-কলাপ হিসেবে ব্যাখ্যা করা চলে না। সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী ঐতিহাসিকদের মতে, ইংরেজদের ধ্যান ধারণা ও জ্ঞান চর্চার অংশীদার হয়ে তবেই ভারতীয় শিক্ষিত বুর্জোয়া শ্রেণি স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রসর হয়েছিল। অর্থাৎ ভারতের জাতীয়তাবাদের উত্থান ইংরেজ শাসনেরই পরোক্ষ ফল। অন্যদিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা মনে করেন, দেশের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। ঐতিহাসিকরা কিন্তু সাধারণ স্তরের মানুষ যারা বুদ্ধিজীবী বা এলিট শ্রেণীর গণ্ডির বাইরে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামের বিশেষ অবদান রেখেছিল সেই দিকে দৃষ্টিপাত করেন নি বা গুরুত্ব দেননি। উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, ১৯১৯ এ রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে এবং ১৯৪২ এ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অংশ হিসেবে নিম্নবর্গের মানুষ যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত অভিযানে নেমেছিল সেই ইতিহাস এলিট হিস্ট্রিতে অনুচ্চারিত থেকে গেছে।
নিম্নবর্গের জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, যা ছিল প্রকৃত জনগণের জাতীয়তাবাদ, তার সাথে উচ্চ বর্গের রাজনীতির গঠনগত বৈপরীত্য ছিল। ভারতীয় সমাজের এই দুই অংশ সম্পূর্ণ আলাদা মানসলোকে বাস করত। দুইয়েরই মানবিক জগৎ ছিল স্বশাসিত। যদিও তা নিশ্চিদ্রভাবে রুদ্ধ ছিল না। বুর্জোয়াদের শুরু করা রাজনৈতিক আন্দোলনে বিভিন্ন সময় নিম্নবর্গীয়রা যদিও অংশ নিয়েছিল তাও বুর্জোয়ারা সমগ্র জাতির হয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে কিছু বলতে ব্যর্থ হয়েছিল। পরবর্তীকালে এক গবেষণায় গুহ দেখিয়েছেন যে, বিশ্বাস উৎপাদন করেই হোক আর জোর করেই হোক বুর্জোয়া নেতৃত্ব তার ভাবাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছিল; কারণ সেই কর্তৃত্বকে বারবার প্রশ্ন করেছে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণী, যাদের কাজকর্মেরও আন্দোলনের একটা আলাদা ঘরানা আছে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এই ঘরানাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে।
নিম্নবর্গের ইতিহাস রচয়িতাগন ভারতীয় সমাজের একেবারে শিকড়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন এ কথা সত্য। কিন্তু নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা কখনোই সার্বিক ইতিহাস হয়ে উঠতে পারেনি। আবার এ কথাও ঠিক যে গতানুগতিক ইতিহাস চর্চাও কোনকালেই সামগ্রিক ছিল না এবং সেখানে নিম্নবর্গের মানুষ বরাবরই অবহেলিত ছিল। সেই অবহেলিত মানুষের বহুদিনের অন্ধকারে জমে থাকা অজানা, অচেনা কথাগুলিকে তুলে ধরে জাতির ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে একথা স্বীকার করতেই হবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন