ভারতীয় জাতীয়তাবাদ: জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চা | Indian Nationalism : Nationalist Historiography
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম সমালোচনামূলক গ্রন্থ রচনা করে যাঁরা জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চার সূচনা করলেন তাঁরা হলেন দাদাভাই নওরজি এবং রমেশ চন্দ্র দত্ত। দাদা ভাই নৌরোজির রচিত Poverty and Unbritish Rule in India এবং রমেশ চন্দ্র দত্ত রচিত Economic History of India গ্রন্থ দুটি উপনিবেশিক অর্থনীতির সমালোচনা করে ভারতের সম্পদ নিষ্কাশন ও অর্থনৈতিক অবক্ষয় এর উপর একটি জাতীয়তাবাদী তত্ত্ব নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে আরো অনেকেই যেমন পট্টভি সীতারামাইয়া, তারাচাঁদ, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, আর এস মেহরোত্রা প্রমূখ পণ্ডিত জাতীয়তাবাদী রচনায় অংশগ্রহণ করেছেন।
জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা ভারতে জাতি গঠনের প্ৰক্রিয়াটি বোঝার চেষ্টা করতেন প্রধানত জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের শ্রেষ্ঠত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। তারা মনে করতেন, জাতীয় চেতনাই এখানে মুখ্য, বাকি সব চেতনা (জাতিগত, সম্প্রদায়গত, শ্রেণীগত) তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। উপনিবেশিক শাসনের প্রতি মূলগত অনীহা থেকেই এই ধরনের চেতনার জন্ম হয়। ভারতবর্ষের প্রাচীন পরম্পরা সম্বন্ধে যে গর্ববোধ ছিল তার মধ্যেই নিহিত ছিল তার অনুভূতি ও ভাবাদর্শ। তারা আরো মনে করেন, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম একটি সার্বজনীন ব্যাপক ও সর্বাত্মক রূপ পেয়েছিল। গোটা ভারতবর্ষের সমস্ত অঞ্চল, সকল ধর্মাবলম্বী ও যাবতীয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এই সংগ্রামে সামিল হয়েছিল। কৃষক, শ্রমিক ও দলিত মানুষের লড়াইকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ।
জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র মনে করেন বিভিন্ন ধর্মী রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত স্রোতের সহাবস্থান হয়েছিল ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে। এই আন্দোলন প্রথম থেকেই ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন। যদিও সাম্প্রদায়িক হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে দেশভাগ এড়ানো যায়নি। তবুও স্বাধীন ভারত তার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে ঊর্ধে তুলে ধরেছিল। স্বাধীনতার সংগ্রাম সর্বদাই একটি নির্দিষ্ট নীতির অনুসরণ করে চলেছিল, তাহল 'সংঘাত-সমঝোতা-সংঘাত'-এর নীতি। ভারতের জাতীয় আন্দোলন ছিল বিভিন্ন শ্রেণীর আন্দোলন। এই আন্দোলন কখনই কেবলমাত্র বুর্জোয়া শ্রেণীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত হয়নি। এই আন্দোলন সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শকেও খোলা মনে গ্রহণ করেছিল। আন্দোলনের নানা স্তরে জাতিগত বিরোধ, সাম্প্রদায়িক সংঘাত, শ্রেণীগত সংঘর্ষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মুক্তিসংগ্রামের গতি সঞ্চার হয়েছিল তখনই অন্যান্য দ্বন্দ্ব গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল।
জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চার প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে এর এলিটিস্ট গড়ন। শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক সংগ্রাম এবং দলিত মানুষের লড়াইকে এই ইতিহাসচর্চা প্রান্তিক বিষয়ে পরিণত করেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস বীরপুজোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, কয়েকজন মহান নেতার নির্বিচার গৌরব গাথায় পরিণত হয়েছে। সুমিত সরকার দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেখিয়েছেন রমেশচন্দ্র মজুমদারের রচনায় শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু সম্পর্কে এমনই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে যে দ্বিজাতি পরিমার্গ খোলাখুলিভাবে সেখানে সমর্থিত হয়েছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন